বগুড়া প্রতিনিধি : ভীষণ চাপের মুখেও নুয়ে যাননি তিনি। দুর্দান্ত সাহসের সাথে গ্রামের সুবিধাভোগী ফতোয়াবাজ মাতবরদের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। একাই লড়ে যাচ্ছেন বগুড়ার শাজাহানপুরের কড়িআঞ্জুল গ্রামের গোলাপী বেগম।
হিল্লা বিয়ের ফতোয়া দিয়ে একঘরে করে রাখা ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে স্থানীয় শাজাহানপুর থানায় মামলা ঠুকে দিয়েছেন তিনি। এ ঘটনায় পুলিশ গ্রেফতার করেছে চার মাতবরকে। গা-ঢাকা দিয়েছেন অন্য ফতোয়াবাজরাও।
টানা এক বছর একঘরে থাকার পর মুক্তজীবনে ফিরে গোলাপী বেগম দু’সন্তান নিয়ে গেছেন বাপের বাড়িতে। নিরাপদ আশ্রয়ে আছেন তিনি।
ফতোয়াবাজি নির্মূলে কড়িআঞ্জুল গ্রামে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে নতুন করে আর কেউ গ্রেফতার হয়নি।
গোলাপীর প্রবাসী স্বামী আব্দুল মোমিন হঠাৎ রাগ করে ফোনে তালাক দিতে চেয়েছিলেন গোলাপীকে। পরদিন আবার সে কথা ফিরিয়েও নেন তিনি। কিন্তু মোমিনের ফোনে গোলাপীর দুনিয়াটা উলেট দেয়ার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন তার ভাসুর মোখলেসুর রহমান।
এ কথা গ্রামে প্রচার করে ফায়দা লোটার চেষ্টায় মেতে ওঠেন তিনি। সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা থেকে তাকে ও তার সন্তানদের বঞ্চিত করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। মোখলেসুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ষড়যন্ত্র পাকাতে থাকেন এলাকার মাতবরদের নিয়ে।
গোলাপীর হিল্লা বিয়ের সিদ্ধান্ত দেন তারা। যতেদিন এ সিদ্ধান্ত না মানবে ততেদিন তাকে একঘরে করে রাখার সিদ্ধান্ত নেন মাতবররা। টানা এক বছর চলে এ অপকর্ম। ফতোয়াবাজ মাতবরদের ভয়ে এলাকার সাধারণ মানুষ গোলাপীর সঙ্গে ওঠাবসা বন্ধ করে দেন।
গত বছরের কোরবানির ঈদের আগে শুরু হয়েছিল মাতবরদের এ তৎপরতা। এ বছরের কোরবানি ঈদে মাতবরদের ভয়ে কেউ তাদের এক টুকরো মাংসও দেয়নি। এরপরও গোলাপীকে হিল্লা বিয়ের চাপ অব্যাহত রাখেন তারা।
এতে ত্যাক্তবিরক্ত হয়ে ৮ অক্টোবর ভাসুরসহ পাঁচ মাতবরের নামসহ অজ্ঞাত আরো ১২-১৩ জনের নামে মামলা করতে বাধ্য হন গোলাপী বেগম। সাহসী এ নারীকে সাহস জোগাতে তার পাশে দাঁড়ায় পুলিশ। এ ঘটনায় গ্রেফতার হয় চার ফতোয়াবাজ মাতবরকে।
শুক্রবার স্থানীয় গৃহবধূরা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে তার সাহসের প্রশংসা করেন। তারা জানান, এতেদিন মাতবরদের ভয়ে বাড়ি থেকে কোথাও যেতে পারেননি তিনি। এবার বুক বেঁধে নেমেছেন তিনি।
এদিকে বৃহস্পতিবারও কড়িআঞ্জুল গ্রামে রাতভর অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযানে কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তবে থানা পুলিশ বলেছে, অভিযান অব্যাহত থাকবে। যেকোনো মূল্যে আসামিদের গ্রেফতার করা হবে।
শাজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেন সাংবাদিকদের জানান, বৃহস্পতিবার রাতে কড়িআঞ্জুল গ্রামে অভিযান চালানো হয়। ফতোয়াবাজদের কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে গেছেন তারা। যেকোনো মূল্যে শাজাহানপুর উপজেলায় ফতোয়াবাজি নির্মূল করা হবে।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, প্রায় এক যুগ আগে কড়িআঞ্জুল গ্রামের খোরশেদ আলমের ছেলে আবদুল মোমিন গোলাপী বেগমকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে দুটি সন্তান রয়েছে। দেড় বছর আগে মোমিন মালয়েশিয়ায় যান।
তারা জানান, গতবছর ঈদের আগে মালয়েশিয়া থেকে মোবাইল ফোনে রাগে তাকে তালাক দিতে চেয়েছিলেন। পরদিন আবার স্বামী ভুল বুঝতে পেরে দুঃখ প্রকাশ করেন। কিন্তু তার ভাসুর মোখলেসুর রহমান বিষয়টি জানতে পেরে এ কথা গ্রামে প্রচার করেন। এ নিয়ে গ্রামে এক বছর ধরে কানাঘুষা চলছিল।
তারা জানান, গত ২৩ সেপ্টেম্বর ভাসুরের ডাকে গ্রামে সালিশ বৈঠক বসে। বৈঠকে গ্রেফতার হওয়া চার মাতবর ছাড়াও একই গ্রামের পুটু মিয়া রায় দেন যে, মোমিন ফোনে ভুল স্বীকার করলেও গোলাপীর তালাক হয়ে গেছে। তাই তাকে সংসার করতে হলে অন্য একজনের সঙ্গে হিল্লা বিয়ে দিতে হবে।
তিনি এও বলেন, নতুন করে তাদের বিয়ে পড়াতে হবে। গোলাপী বেগম তাদের এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে। তাকে দুই সন্তানসহ একঘরে ঘোষণা করা হয়। গোলাপী বেগমকে এ ঈদে কোরবানি দিতেও দেয়া হয়নি। গ্রামের কেউ তাদের মাংসও দেয়নি।
গত ১৪ দিন ধরে গোলাপী সন্তানদের নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছিলেন। এ অবস্থায় ৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় ভাসুর ও পাঁচ মাতবরের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ১২-১৩ জনের বিরুদ্ধে শাজাহানপুর থানায় মামলা করেন।
রাতেই অভিযান চালিয়ে নিজ নিজ বাড়ি থেকে পুলিশ ফতোয়াবাজ মাতবর ফজলুর রহমান, আনছার আলী, মোজাফফর রহমান ও আবদুল আলিমকে গ্রেফতার করে। অপর মাতবর পুটু মিয়া ও ভাসুর মোখলেসুর রহমান পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
৯ অক্টোবর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/প্রতিনিধি/এমআর