এমটিনিউজ ডেস্ক: অনলাইনে টাকা বিনিয়োগ করে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার লোভে এমটিএফই অ্যাপে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছে বগুড়ায় হাজারো মানুষ। তবে লোকলজ্জা-আইনি জটিলতার ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। তাদের দাবি- এমন প্রতারকদের আইনের আওতায় আনা হোক।
বগুড়ায় কতজন এমটিএফই’র প্রতারণার শিকার হয়েছেন তার কোনো সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। তবে এই অ্যাপে বিনিয়োগ করেছিলেন এমন ১০ জন ব্যক্তি জানিয়েছেন, অন্তত ১০ হাজার ব্যক্তি এমটিএফই’র প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
বগুড়া শহরের শাপলা মার্কেটের জেনারেটর মিস্ত্রি মিলন হোসেন তালুকদার। তিনি বগুড়া পৌরসভার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তিনি কয়েক মাস ধরে এমটিএফইতে বিনিয়োগ করছিলেন। তিনি প্রায় সাড়ে আট লাখ টাকা প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
শাপলা মার্কেটে রাজিব নামে এক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে এই এমটিএফই’র সন্ধান পান মিলন। তার মাধ্যমে সবাই বিনিয়োগ করেন। রাজিব জেনেছিলেন রামমোহন চন্দ্র বর্মণের কাছে। তিনি ছিলেন সিইও। কিন্তু এখন অধিকাংশ ব্যবসায়ী বা কর্মচারী দোকানেও আসছেন না। স্বীকারও করছেন না বিনিয়োগের কথা।
মিলন হোসেন তালুকদার বলেন, আমার নিজের টাকা খরচ করে বিনিয়োগ করতে হয়নি। তারাই ২৬ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়। ওই সময় বলেছিল, কাজ করে টাকা শোধ করে দিয়েন। আপনি থাকবেন না, কিন্তু এমটিএফই থাকবে।
পরে আমি এতে টাকা বিনিয়োগ করি। আমার স্ত্রী ও ভায়রাকেও অ্যাকাউন্ট খুলে দিই। ওরা বলেছিল এটা ফরেন ট্রেডিংয়ে বিনিয়োগ হয়। আর সত্যি কথা বলতে, টাকা রিটার্ন আসতে দেখে আমি বিনিয়োগ করি। বিনিয়োগের জন্য ঋণও করেছি। তারপর তো প্রতারিত হলাম। এই টাকা হয়তো আর কখনো তুলতেও পারবো না।
তিনি বলেন, লোভে পড়েই বিনিয়োগ করেছিলাম। সবাই তাই করেছে। কেন করবে না। চোখের সামনে দেখছে কোটি কোটি টাকা। এই রামমোহনের অ্যাকাউন্টে দেখানো হয়েছিল ১৬ লাখ ১৪ হাজার ৮৬২ ডলার।
ব্যবসায় কোনো ক্ষতির স্বীকার হননি বলে দাবি করেন মিলন। পথেও বসেননি। কিন্তু ঋণ করে টাকা বিনিয়োগের কারণে বড় ধাক্কা পড়েছে তার জীবিকায়।
তার ভাষ্য, অনেকে তাকে এসব বলতে নিষেধ করছেন। কিন্তু তিনি চান মানুষ জানুক এইসব প্রতারকদের কথা। তাহলে অন্যরা সতর্ক হবে।
বিষয়ে কথা বলতে শাপলা মার্কেটের ব্যবসায়ী রাজিবের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
মার্কেটের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, অধিকাংশরা শুনেছে এমটিএফইতে বিনিয়োগ বৈধ নয়। বিনিয়োগের বিষয়টি জানাজানি হলে তারা যদি কোনো ঝামেলায় পড়ে এই ভয়ে কেউ কথা বলছে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, রামমোহন কিছু দিন আগে বগুড়া শহরের তিন মাথা এলাকার একটি আবাসিক ভবনে অফিসও নিয়েছিলেন। গত ১০ আগস্ট সেখানে বেশ ঘটা করে অফিস উদ্বোধন করেন। এ ছাড়া আগেও বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে মিটিং হতো। প্রচুর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা থাকতো। এসব মিটিংয়ে ২৫০ থেকে ৩০০ জন করে মানুষ অংশ নিতেন। বগুড়ার বাইরের জেলার একাধিক সিইও আসতেন।
শুধু তাই নয়, এসব মিটিংয়ের ব্যয় এমটিএফই বহন করতো। প্রতি ৩০ মানুষের জন্য আয়োজনে এই প্রতারক প্রতিষ্ঠানটি ১০০ ডলার করে দিতো। আর অফিস নেওয়ার জন্য দিয়েছিল ৫০০ ডলার। এসব মিটিংয়ে তারা বিনিয়োগকারীদের এসব শোনাতেন।
এদিকে তিন মাথা এলাকায় খোঁজ নিলে সেখানকার কোনো বাসিন্দা এমন অফিসের কথা বলতে পারেননি। তবে এমটিএফই’র বড় টিম পরিচালনাকারী অহিদুর রহমানও ওই অফিসের বিষয়টি জানান।
তিনি বলেন, অল্প কিছুদিন আগে রামমোহন ওই অফিস নিয়েছিলেন। এখন আর কিছু পাবেন না। সব বন্ধ হয়ে গেছে।
অহিদুর রহমান অনলাইন লিংকের মাধ্যমে খোঁজ পেয়ে পর্যায়ক্রমে প্রায় ৭০০ ডলার বিনিয়োগ করেছিলেন। তার লিংকে ছিলেন অন্তত ৩৫ জন। তার নিজের ৩৫ হাজার টাকা উধাও হয়ে গেছে বলে দাবি করেন অহিদুর।
এই বিনিয়োগকারীর বলেন, ২০২২ সালের আগস্ট থেকে এমটিএফই কার্যক্রম শুরু করি। যারা ডেসটিনি করতেন তারাই এই এমটিএফই চালাতেন। রামমোহন ছাড়া ফরিদ নামে আরেক সিইও ছিলেন। এদের হাতে বগুড়ার প্রচুর মানুষ এমটিএফইতে যুক্ত হয়েছিলেন। এই সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের কম হবে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শহরের আরও এক বিনিয়োগকারী দাবি করেন, বগুড়ায় অন্তত ১০ হাজার ব্যক্তি এমটিএফইতে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছেন। একটা প্রোমো কোড বা রেফারেন্স দিয়ে তাদের কাজ শুরু হয়। সোমবার ট্রেডিংয়ের জন্য বিনিয়োগকারীরা নিজেদের অ্যাকাউন্ট লগইন করে সুইচ অন করে দিতেন। আর কিছু করা লাগতো না। এই সহজ পদ্ধতি মানুষদের বেশি আকৃষ্ট করে।
জানা গেছে, রামমোহন চন্দ্র বর্মন জয়পুরহাটের ক্ষেতলালের বাসিন্দা। কিন্তু তিনি বগুড়া শহরের চেলোপাড়ার একটি মেসে থাকতেন। ঘটনার পরপরই তিনি সটকে পড়েছেন।
আর ফরিদের বাড়ি বগুড়ায়। তবে বগুড়ার কোন এলাকায় তা কেউ বলতে পারেননি। আর তিনি বগুড়ায় কম থাকতেন। রাজশাহী, সাতক্ষীরা এসব এলাকায় বেশি কাজ করতেন। তার রাজশাহীতে অফিসও ছিল।
রামমোহনের কাছে এসব বিষয় জানতে ফোন দেওয়া হয়। কিন্তু তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারীরা জানান, রামমোহন বা ফরিদ অফিস নিয়ে সামনা-সামনি কথা বলে সদস্য সংগ্রহ করতেন। এর বাইরে সরাসরি অনলাইনের লিংক থেকে যুক্ত হয়ে বিনিয়োগ করা যেত। এভাবে তরুণ বা শিক্ষার্থীরা বেশি বিনিয়োগ করেছেন।
তবে যেভাবেই বিনিয়োগকারী আসুক, সবাইকে এমটিএফই থেকে বলা হতো- এসব টাকা বৈদেশিক ব্যবসাতে বিনিয়োগ করা হয়। আর সাইটেও বিভিন্ন পণ্য দেখানো হতো। সর্বনিম্ন ২১ ডলার দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা যেত। সপ্তাহে পাঁচদিন ট্রেডিং চলতো। শনিবার ও রোববার বন্ধ থাকতো। আর শুক্রবার করে এমটিএফই তাদের সদস্যদের সঙ্গে জুম মিটিং করতো।
ইউটিউবে এমটিএফই সম্পর্কে জেনে বিনিয়োগ করেন এমন একজন সদরের বেলাইল এলাকার তাসিন নামে এক শিক্ষার্থী। প্রায় এক মাস আগে এমটিএফইতে ২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, আগস্টের প্রথম দিকে মূল টাকা তুলে নিয়েছিলাম। লাভের কিছু টাকা ছিল, সেগুলো আর তুলতে পারিনি। এসব প্রতারকদের আইনের আওতায় আনা উচিত। তাহলে সাধারণ মানুষ আর ভুক্তভোগী হবে না।
ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কর্মরত দীপ্ত হাসান রকি নামে এক যুবক বলেন, এমটিএফই টাকা নিয়ে চলে গেছে। এর আগে ইম্পেরিয়াল ক্রাউন, ডিজিটাল আইটি ওয়াল এমন নানা নামে এসব সাইট উদ্ভব হয়েছে। সাধারণ মানুষের টাকা নিয়ে তারা কিছু দিন পর উধাও হয়ে যায়। আসলে ক্রিপ্টোকারেন্সি অবৈধ হওয়ায় এদের ধরতেও পারে না প্রশাসন। আর মানুষের তো লোভ আছেই।
এসব অবৈধ ক্রিপ্টোকারেন্সি চ্যানেল মনিটরিংয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে কিনা- জানতে চাইলে বাংলাদেশে ব্যাংকের বগুড়া শাখার নির্বাহী পরিচালক ও জেলা ব্যাংকার্স ক্লাবের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা ছাড়া এ নিয়ে কথা বলা যাবে না। তবে সাধারণ মানুষকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার স্নিগ্ধ আখতার বলেন, এ বিষয়ে আমাদের কাছে এখনো কেউ অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে আমরা কাজ করবো। সূত্র: ঢাকা পোস্ট