ইসমত মর্জিদা ইতি, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম-৫ আসন (হাটহাজারী ও সিটির ১ ও ২ ওয়ার্ড) থেকে আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে জটিলতায় পড়তে পারে বিএনপি। কারণ রয়েছে একাধিক প্রার্থী। তাদের সবাই মনোনোয়ন প্রত্যাশী। এক সময়ে বিএনপির দুর্গ বলে পরিচিত ছিল চট্টগ্রামের এ আসনটি। কিন্তু গত ২০০৮ নির্বাচনে মহাজোট প্রার্থীর কাছে ধরাশায়ী হওয়ার পর হাতছাড়া হয়ে যায় তাদের সেই ঘাঁটি। আগামী নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে বড় ধরনের কোন সংকট তৈরি না হলে বিএনপি পুনরায় আসনটি ফিরে পাবে- এমন ধারণা বিএনপির তৃণমূল নেতা-কর্মীদের।
আর নির্বাচনকে সামনে রেখে হেফাজতকে হাতে রাখতে চায় দলের ভাইস চেয়ারম্যান মীর নাসির। আর বিভিন্ন সাংগঠনিক কর্মকান্ডে অংশ নিয়ে নতুন কৌশলে এগুচ্ছে জেলা বিএনপির সদস্য ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা। একই সাথে বিএনপি থেকে এ আসনে মনোনোয়ন প্রত্যাশীর নাম রয়েছে চাকসু জিএস এসএম ফজলুল হল, মীর নাছিরের ছেলে ব্যারিস্টার হেলাল।
জানা যায়, শাকিলা ফারজানা দেশে ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করেছেন। পরে লন্ডন থেকে অর্জন করেন ব্যারিস্টার অ্যাট ল’ ডিগ্রি। 'জঙ্গি অর্থায়নে অভিযুক্ত' এ আইনজীবী জামিনে কারামুক্তির পর থেকে তার নিজ এলাকা চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। ঢাকায় থাকলেও সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন তিনি হাটহাজারীতে অবস্থান করছেন। এলাকায় দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠকের পাশাপাশি দলীয় নানা কর্মসূচির আয়োজন করে তাতে অংশও নিচ্ছেন।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের মেয়ে। আর হাটহাজারী আসনে চার দফায় সংসদ সদস্য ছিলেন সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম।
জানা যায়, জঙ্গি অর্থায়নে'র অভিযোগে ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট ঢাকার ধানমন্ডি থেকে শাকিলাসহ গ্রেফতার হন তিন আইনজীবী। শহীদ হামজা ব্রিগেডের সামরিক কমান্ডার ডনের অ্যাকাউন্টে অর্থ জমা দেওয়ার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। তারপর গতবছরের ৫ জুন জামিন পান এবং ৭ জুন কারাগার থেকে মুক্তি পান শাকিলা।
এর আগে আইনজীবী ফোরামের ব্যানারে হাইকোর্টে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও নিজ এলাকায় বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না ব্যারিস্টার শাকিলা। এবার কারাগার থেকে বের হওয়ার পর এলাকায় পুরোদমে দলীয় কর্মকান্ডে মনোনিবেশ করেছেন তিনি।
শাকিলা ফারজানা নিজের অভিব্যক্তির কথা জানাতে গিয়ে বলেন, দলের জন্য আমার বাবা সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের ত্যাগ ও অবদান অপরিসীম। এর আগেও চার দফায় নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপি নির্বাচনে গেলে হাটহাজারী আসনে দল থেকে প্রথমে তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে। কিন্তু তিনি অসুস্থ। তাই এলাকায় তার অবস্থান ধরে রাখতে আমি কাজ করছি। এ ছাড়া দলের জন্য এলাকায় কাজ করতে আমার প্রতি বিএনপির হাইকমান্ডেরও নির্দেশনা রয়েছে।'
স্থানীয় বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, আগে থেকে এখানে মীর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন ও তার পুত্র মীর হেলাল এবং বিজিএমইএ নেতা চাকসু জিএস এসএম ফজলুল হক আগামী সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন লাভের আশায় কাজ করছেন। বিএনপিপন্থি জোটের পক্ষে কল্যাণ পার্টির নেতা মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম ও হাটহাজারী থেকে সামনের সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। তবে পিতার উত্তরাধিকার নিয়ে ব্যারিস্টার শাকিলার আগমন বিএনপির রাজনীতিকে আরও জটিল ও উত্তেজিত করবে বলে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীর অভিমত।
তবে দলীয় সূত্রে আরো জানা যায়, ব্যারিস্টার শাকিলার রাজনৈতিক আত্মপ্রকাশকে নিরীক্ষা করা হবে। পিতার পথ ধরে যদি তিনি এলাকায় যথেষ্ট সাড়া জাগাতে পারেন তাহলে মনোনয়নের পাল্লা তার দিকে ঝুঁকবে।
বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জানান, এবার পুরনো প্রার্থীর সঙ্গে টেক্কা দিতে ওই আসনে নেমেছেন আরও বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট। এসব সম্ভাব্য প্রার্থীর সঙ্গে চেয়ারপারসনের সরাসরি যোগাযোগ থাকায় নমিনেশন পাওয়ার বিষয়টি তাই প্রকট হয়ে উঠেছে। যা নির্বাচনে দ্বন্দ্বে রুপ নিতে পারে।
এদিকে গত ১৯ আগষ্ট হাটহাজারীতে সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রমে ব্যারিস্টার শাকিলা বলেছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই জনগণের চাহিদা অনুযায়ী অবিলম্বে সহায়ক সরকারের মাধ্যমে আগামী সংসদ নির্বাচন দেয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, বিএনপির সদস্য সংগ্রহ অভিযান অব্যাহত থাকবে। ১৮ বছরের অধীক এবং পুরানো সদস্য নবায়ননের মাধ্যমে তৃণমূল রাজনীতিকে আরো শক্তিশালী করে গড়ে তুলা হবে। সংগঠনের কাঠামো শক্তিশালী করার মাধ্যমে আগামী দিনে স্বৈরশাসক আওয়া মীলীগের বিরুদ্ধে রাজপথে জোরালো অবস্থান গড়ে তোলার মধ্যদিয়ে সরকারের পতন নিশ্চিত করা হবে।
শাকিলা আরো বলেন, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে কালো অধ্যায়ের সূচনা ঘটিয়েছে। প্রশাসনকে অবৈধভাবে ব্যবহার করে, সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ দলীয় প্রভাবের আওতায় এনে প্রশাসন এবং জনগণের মধ্যে বিভেদ গড়ে তুলেছে।
এদিকে মীর নাছিরের হঠাৎ করে হেফাজত নেতার সাথে সাক্ষাত নিয়ে এলাকায় মুখরোচক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছিলো। আলোচনায় এসেছিলো, আগামী সংসদ নির্বাচনে হেফাজতকে হাতে রেখে মীর নাছির নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। কারণ হাটহাজারীতে হেফাজতের একটা বড় সমর্থকগোষ্ঠী রয়েছে। তাই হেফাজতের সখ্যতার কারনে সেই ভোটব্যাংককে সে কাজে লাগাতে পারেন।
গত ৬ মে মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের তান্ডবের চতুর্থ বার্ষিকীতে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এ সংগঠনের আমির শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে দেখা করেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন। ঐদিন হাটহাজারীতে অবস্থিত দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় শফীর কার্যালয়ে যান নাছির।
হেফাজত আমিরের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ‘সখ্য’ নিয়ে যখন বিএনপি নেতারা সমালোচনায় সরব ছিলেন সেই সময় আহমদ শফীর কাছে গিয়েছেন তাদের দলেরই একজন জ্যেষ্ঠ নেতা। আওয়ামী লীগ কৌশলে হেফাজতে ইসলামের সান্নিধ্যে যাওয়ায় বিএনপি নেতারা এখন সংশয়ে আছেন যে আগামী নির্বাচনে তারা হেফাজতের সমর্থন পাবেন কি না। জানা গেছে, বিএনপিও হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে কৌশলে সম্পর্ক উন্নয়নের পরিকল্পনা করছে। ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার মতিঝিলে তান্ডব চালিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। তার বার্ষিকী উপলক্ষে সংগঠনটি গত ৫ মে কোনো কর্মসূচি পালন করেনি।
এ অবস্থায় বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে ইঙ্গিত পেয়েই নাছির সেখানে গিয়েছিলেন বলে ধারনা করা হয়েছে তখন।
এ আগের মাসে গণভবনে শাহ আহমদ শফীসহ কওমির ওলামাদের নিয়ে এক অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারণে হেফাজতের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি কওমির সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা দেন তিনি।
এরপর জঙ্গিবাদের বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন হেফাজত আমির। হেফাজতের সঙ্গে সরকারের এই ‘সমঝোতার’ সমালোচনা করে বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচনে জিততে আহমদ শফীর সঙ্গে ‘সখ্য’ গড়ছেন শেখ হাসিনা। মীর নাছির এমন দিনে আহমদ শফীর কাছে গিয়েছেন ২০১৩ সালের যে দিনে ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে দিনভর তান্ডব চালিয়েছিলেন হেফাজতকর্মীরা।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে মীর নাছির জানান, আমি দল থেকে মনোনোয়ন পেয়ে নির্বাচিত হলে হাটহাজারীর বেকার সমস্যার সমাধান করব। রাস্তাঘারে উন্নয়ন করব। আমার ৪০ বছরের রাজনীতি জীবনে যা করেছি , তা শেষটা করব হাটহাজারীবাসীর জন্য।
হেফাজতের সাথে দেখা করা আগামী নির্বাচনে হেফাজতকে হাতে রাখার কৌশল কিনা এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এই শীর্ষ নেতা জানান, হেফাজতের সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্ক। রাজনীতির সম্পর্ক এখানে মূখ্য না। আর দেখা করলে অসুবিধা কি? আওয়ামী লীগ করলে দোষ নেই, বিএনপি করলে দোষ কেন?
তবে ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা ও তার ছেলে ব্যারিস্টার হেলালের একই আসন থেকে মনোনোয়ন প্রত্যাশী হওয়ার বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, আমি আমার ছেলে-মেয়ে বয়সী কাউকে নিয়ে কিছু বলতে চাইনা। দল সেটা দেখবে।পূর্বপশ্চিমবিডি।
এমটি নিউজ২৪ডটকম/আ শি/এএস