এস এম রানা, চট্টগ্রাম: নগরের বন্দর থানা এলাকার একটি স্কুলের ছাত্রী তানজিলা আলম (ছদ্মনাম)। লেখাপড়ায় ভালো। পরিবারের আর্থিক অবস্থাও ভালো। সেই পরিবারের এক সদস্য এক রাতে নিজের ফেসবুকের ইনবক্সে একটি ছবি পান। ছবিটি দেখে তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ে। কারণ, ছবিটি তানজিলা আলমের।
মেয়ের এমন ছবি দেখবেন, তা কল্পনাও করেননি অভিভাবক। বিস্মিত অভিভাবক তৌহিদুল আলমের (ছদ্মনাম) হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। এমন কাজ কে করেছে, সেটা বের করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মেয়েকে কিছুই যেন জিজ্ঞেস করতে পারছিলেন না।
ওই একটি ছবিতে পরিবারের সদস্যদের মুখ গোমড়া হয়ে যায়। হাসি আনন্দের পরিবারে নামে অমানিশার অন্ধকার। এরই মধ্যে এক নিকটাত্মীয় ফোন করলেন তৌহিদুল আলমকে। ওই আত্মীয় যা বললেন, তাতে তিনি হতবাক। অন্য ধরনের আরো একটি খোলামেলা ছবি পেয়েছেন তিনি। ফেসবুকের ইনবক্সে এমন ছবি পেয়েই সতর্কতামূলকভাবে তৌহিদুল আলমের কাছে ফোনে বিষয়টি জানান ওই আত্মীয়।
এভাবে বেশ কয়েকজন আত্মীয় তানজিলা আলমের ভিন্ন ভিন্ন ছবি পেলেন। বিষয়টি নিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যেও নানা কথা হচ্ছে। কানাঘুষা ক্রমেই বাড়ছে। নানাজনের কান ঘুরে কথা চলে আসে তানজিলা আলমের কানেও। তানজিলা ছবিগুলো দেখেই বিস্মিত। এ ধরনের ছবিগুলো কার কাছে থাকতে পারে, সেটা বুঝতে পারেন তানজিলা। তিনি দ্রুত ফোন করেন তার বন্ধু আবির হাসানকে (ছদ্মনাম)। আবির হাসান প্রায় ৩২ বছর বয়স্ক ব্যক্তি। তানজিলা যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে, তখন থেকেই আবিরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নিকটাত্মীয় হওয়ায় দুজনের কথোপকথনকে কেউ সন্দেহের চোখে দেখেনি। কিন্তু পরের সময়টা গড়িয়ে যায় বহুদূর।
আবির-তানজিলার যোগাযোগ চলে ফেসবুকের ইনবক্সে। সেখানেই তাদের অন্তরঙ্গ কিছু ছবি বিনিময় হয়। আর দুজনের শারীরিক সম্পর্কও চলছিল। তানজিলা এখন দশম শ্রেণির ছাত্রী। তিন বছরের সম্পর্ক চললেও সামপ্রতিক সময়ে তানজিলা আর সাড়া দিচ্ছিল না আবিরের ডাকে। এতেই ক্ষোভ জন্মে আবিরের। তানজিলা ছবিগুলো দেখে আবিরকে সন্দেহ করলেও আবির সরাসরি অস্বীকার করেন। আবিরের দাবি, এই কাজ তিনি করতেই পারেন না। আবির নিজের পরিবারের সদস্যদের সামনে একাধিক দফা শপথ করে দাবি করেছেন, তিনি তানজিলার ছবি কখনো কাউকে দেননি। তানজিলার সঙ্গেও এ ধরনের কোনো সম্পর্ক নেই তাঁর। আবিরের বলার ভঙ্গি ও শপথের কারণে দুই পরিবারের সদস্যরা বিশ্বাস করেন তাঁকে। আবিরকে বিশ্বাস করলেও বাস্তবে ছবি ইনবক্সে আসা থামছেই না। এতে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে তানজিলাসহ তার পরিবার।
শেষে নিরূপায় হয়ে তানজিলার পরিবার নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগমের শরণাপন্ন হয়। আমেনা বেগম এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (বন্দর) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে দায়িত্ব দেন। নির্দেশনা পাওয়ার পর অজ্ঞাত ব্যক্তিরা ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারের তানজিলার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি পাঠাচ্ছে-এটা জেনে গোয়েন্দারা অভিযান শুরু করেন। অভিযানের বিষয়ে নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (বন্দর) আসিফ মহিউদ্দীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘উপ-কমিশনার স্যারের নির্দেশনার পর আমরা অভিযান শুরু করি। অভিযানের শুরুতে গোয়েন্দা কার্যালয়ে ডেকে আনা হয় আবির হাসানকে। শুরুতে তিনি যথারীতি অস্বীকার করেন। এরপর আমরা ফেসবুকের যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে ছবিগুলো এসেছে, সেসব অ্যাকাউন্টের ওপর নজরদারি চালাই। এতে আবির হাসানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। পরে আবির হাসানের মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও পেনড্রাইভের তথ্য খতিয়ে দেখি। শেষে নিশ্চিত হই, আবিরই ছদ্মনামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে তানজিলার পরিবারের সদস্যদের অন্তরঙ্গ ছবিগুলো পাঠিয়েছিলেন। তানজিলা সাড়া দেওয়া বন্ধ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে এই কাজ করেন তিনি।’ শেষে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর কার্যালয়ে উভয় পরিবারের সদস্যরা এক বৈঠকে মিলিত হয়। দুই পরিবারের সবার সামনেই আবির হাসান ঘটনার দায় স্বীকার করেন। কিন্তু উভয় পরিবার নিকটাত্মীয় হওয়ায় এবং তানজিলার বয়স বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তীতে সামাজিক সমস্যা এড়ানোর জন্য মামলা করতে রাজি হননি। শেষে আবিরকে মুচলেকা নিয়ে অভিভাবকের জিম্মায় দেন গোয়েন্দারা।
এ বিষয়ে নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (বন্দর) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘ভুক্তভোগী যদি মামলা না করেন, তাহলে পুলিশের কিছু করার নেই। তবে আবির হাসানের ওপর নজরদারি অব্যাহত আছে। তার মোবাইল, ল্যাপটপ ও পেনড্রাইভ থেকে যাবতীয় তথ্য মুছে দেওয়া হয়েছে। পরে যদি এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ পুলিশ কর্মকর্তার মতে, ‘পরিবারের শিশু-কিশোরীদের ওপর অভিভাবকদের কড়া নজরদারি প্রয়োজন। শিশু কিশোরীদের হাতে কোনো অবস্থাতেই স্মার্টফোন দেওয়া যাবে না। যদি অভিভাবকরা সচেতন না হন, তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।’-কালের কণ্ঠ