মঙ্গলবার, ০৭ জুন, ২০১৬, ০১:৫৮:০১

ক্লু উদঘাটনে একটি এসএমএস ও কালো মাইক্রোবাস

ক্লু উদঘাটনে একটি এসএমএস ও কালো মাইক্রোবাস

আলম দিদার ও আবু আজাদ : দুর্বৃত্তের হামলায় নিহত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু শনিবার রাতে এক ‘এসএমএসে’ জানতে পারেন রোববার ৭টা ২০ মিনিটে স্কুলে পৌঁছাতে হবে। ঠিক একই মেসেজ এসেছে ‘ইকুইটি সেন্ট্রিয়াম ভবনে’ অবস্থান করা ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সকল অভিভাবকদের কাছে। কিন্তু ক্যান্টনমেন্ট স্কুল কর্তৃপক্ষ সে দিনই একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালকে জানিয়েছিলো এমন কোনও ‘এসএমএস’ তারা পাঠাননি। তাই প্রশ্ন উঠছে, কোথা থেকে এসেছিল সেই এসএমএস?

এদিকে সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে মাহমুদা আক্তার মিতুকে হত্যার দৃশ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে। দুর্বৃত্তরা যখন মিতুকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করছিল, তখন জিইসি মোড়ের দিকে কিছুটা অদুরে দাঁড়িয়ে ছিল একটি কালো মাইক্রোবাস। মিতুর মৃত্যু নিশ্চিত করে ঘাতকরা মোটরসাইকেলযোগে পালিয়ে যাওয়ার ১০ সেকেন্ডের মাথায় ঘটনাস্থলে আসে মাইক্রোবাসটি। পাঁচ সেকেন্ডের মত ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে চলা শুরু করে মাইক্রোবাসটি। পরে গোলপাহাড় মোড়ের দিকে চলে যায়। কালো কাঁচের এ মাইক্রোবাসটির চালকের আসনের পাশের জানালাটা খোলা ছিল। অন্যসব জানালা বন্ধ দেখা গেছে।

ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের স্কুল শাখার উপাধ্যক্ষ সৌমিত কুমার দাশ বলেন, ‘প্রতিদিন নিয়মিত সময়ে স্কুল শুরু হয়। আজ আগেভাগে স্কুল শুরু হবে এমন নির্দেশনা দিয়ে স্কুল থেকে কোনও এসএমএস পাঠানো হয়নি। কর্তৃপক্ষ অভিভাবকদের এসএমএস পাঠানোর ক্ষেত্রে তিনটি ধাপ অনুসরণ করে। প্রথমত, অ্যাডমিন প্যানেল এসএমএসটা তৈরি করে। তারপর সেটা তার দেখার পর আইটি সেক্টরে দেওয়া হয়। তাই কর্তৃপক্ষের অগোচরে অভিভাবকদের কাছে এসএমএস যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

তবে পুলিশ সুপারের স্ত্রী নিহত হওয়ার দিন বাবুল অাক্তারের বাসায় নিয়মিত যাতায়ত থাকা সিএমপির একটি থানার সেকেন্ড অফিসারের এক স্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘মাহির আক্তার নগরীর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ওই স্কুলে আমার ছেলেও পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। আগে স্কুল শুরুর সময় সকাল ৮টা হলেও শনিবার রাতে ভাবি আমাকে ফোন করে জানান তাকে স্কুল থেকে এসএমএস পাঠানো হয়েছে। রোববারে স্কুলে অ্যাসেম্বলি হবে। তাই মাহিরকে সাতটা ২০ মিনিটে স্কুলে পৌঁছাতে হবে। স্কুলের গাড়িও একটু এগিয়ে সকাল ৬ টা ৫০ এর দিকে জিইসি’র মেরিডিয়ান রেস্টুরেন্টের সামনে আসবে। তাই ভাবি ছেলেকে গাড়ি তুলে দিতে ৬ টা ৩০ এর দিকে বাসা থেকে বের হন।’

এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ক্যান্টনমেন্ট স্কুল পড়ুয়া কয়েক শিক্ষার্থী ইকুইটি সেন্ট্রিয়াম ভবনের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে। মাহমুদা খানম মিতুর মৃত্যুর দিন বাবুল আক্তারের বাসায় আসা এরকম এক শিক্ষার্থীর অভিভাবকও তার কাছে স্কুলের সময় পরিবর্তনের এসএমএস আসার কথা জানান। স্কুলের সময় পরিবর্তনের ওই এসএমএসটি শুধু ‘ইকুইটি সেন্ট্রিয়াম ভবনে’ অবস্থান করা ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের কাছে এসেছিল। এছাড়া মাহমুদা খানমের কাছে শনিবার রাতে স্কুল কর্তৃপক্ষের বরাতে এসএমএস যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ।

নগর পুলিশের এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, ‘মাহমুদার কাছে এসএমএস যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এসএমএসটা কারা পাঠিয়েছিল সেটা তদন্ত করা হবে। প্রযুক্তিগতভাবে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টির জন্য এসএমএস ওই ভবনের বাসিন্দাদের কাছেই শুধু পাঠানো হয়েছিল।’

ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ঘড়ির কাঁটায় তখন ৬টা ৩২ মিনিট। এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু তার সন্তান মাহিরের হাত ধরে গলির মুখে এসে পৌঁছান। ঠিক এর ১৫ সেকেন্ড পর বিপরীত প্রান্তে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আগে থেকেই অপেক্ষায় থাকা এক যুবক মোবাইলে কথা বলতে বলতে তাকে অনুসরণ করে পেছন পেছন হাঁটতে থাকেন।

৬টা ৩২ মিনিট ১৪ সেকেন্ডে তিনি ওয়েল ফুডের সামনে পৌঁছানোর সাথে ১ সেকেন্ডের ব্যবধানে পেছন থেকে দৌঁড়ে মিতুর দিকে এগিয়ে যায় ঘাতক। ঠিক একই সময়ে মোটরসাইকেল নিয়ে আগে থেকেই নিরিবিলি হোটেলের সামনে  দাঁড়িয়ে থাকা দুই যুবক মিতুর উপর হামলা করে। হামলা শুরু এবং শেষ করে মোটরসাইকেলে উঠতে ঘাতকরা সময় নিয়েছে মাত্র ১৭ সেকেন্ড! এর মধ্যে মাহমুদা অাক্তার মিতুর শরীরে করা হয়েছে ৮টি ধারালো অস্ত্রের আঘাত ও দুটি গুলি।

৬টা ৩৩ মিনিট ০৫ সেকেন্ডে খুনিরা কিলিং মিশন শেষ করে মোটরসাইকেলে চেপে বসে। তবে মোটরসাইকেলটি চালু হতে সময় নেয় ১৯ সেকেন্ড। ৬টা ৩৩ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে তিন খুনি মোটর সাইকেলে চড়ে পালিয়ে যায়। ৬টা ৩৩ মিনিট ৩৪ সেকেন্ডে আস্তে আস্তে ঘটনাস্থলে, পাঁচ সেকেন্ডের মত ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে চলা শুরু করে মাইক্রোবাসটি। পরে গোলপাহাড় মোড়ের দিকে চলে যায়। কালো কাঁচের এ মাইক্রোবাসটির চালকের আসনের পাশের জানালাটা খোলা ছিল। অন্যসব জানালা বন্ধ দেখা গেছে।

সূত্র জানায়, সংগ্রহ করা ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ঘটনাস্থলের কিছুটা অদুরে একটি কালো মাইক্রোবাস অবস্থান করছিল। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ঘাতকদের ‘ব্যাকআপ’ এর জন্য ওই মাইক্রোবাসে ভারী অস্ত্র ও গ্রেনেড বহন করা হয়েছিল। কোন রকম বাধা আসলে, তা মোকাবেলা করার জন্য ওই মাইক্রোবাসটি আনা হয়েছিল। ত্রিশালে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় জেএমবি এভাবে কালো মাইক্রোবাস ‘ব্যাকআপ’ রেখেছিল।

কেননা, যখন মিতুর ওপর হোন্ডায় থাকা ওই দুইজন ও অনুসরণকারী যুবক আক্রমণ করে এর আগে প্রায় এক মিনিট সময় ধরে ওই কালো মাইক্রোটি ওয়েল ফুডের সামনে আড়াআড়িভাবে রেখে এই সময়ে কোন গাড়ি জিইসি থেকে গোল পাহাড়ের দিকে অাসতে দেয়নি। মিশন শেষে যখন হোন্ডায় করে তিন ঘাতক পালিয়ে যায় তখনই পিছন পিছন ওই কালো মাইক্রোটি হোন্ডার পেছন পেছন চলে যায় গোল পাহাড়ের দিকে।

নগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) পরিতোষ ঘোষ সাংবাদিকদের জানান, হত্যার ধরণ দেখে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তারা আগে থেকেই ঘটনাস্থল রেকি করেছিলেন। ঘটনাস্থল থেকে ১০০ গজ দূরে বাসা থেকে বের হয়ে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে কখন আসবেন, তা নিশ্চয় দুর্বৃত্তরা আগে থেকে খোঁজখবর রাখছিল।

পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী তাঁর ছেলে মাহমুদ আকতার মাহিরকে নিয়ে জিইসি মোড় পৌঁছার আগেই ওয়েল ফুড নামক দোকানের সামনে মোটরসাইকেলে করে তিন আরোহী আসে। যে গাড়ি চালাচ্ছিল, তার মাথায় হেলমেট ছিল। বয়স আনুমানিক ৩০ থেকে ৩৫। তার পেছনে দুজন বসা ছিল। মাঝখানে বসা যুবকের হাতে ছুরি ছিল। পেছনে বসা তৃতীয়জনের হাতে একটি পিস্তল ছিল।

এদিকে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহের পাশাপাশি জিইসি ও আশপাশ সহ হোন্ডাটি কোন পথ দিয়ে এসেছিল, কোন স্থান থেকে যাত্রা শুরু করেছিল সেটি নিশ্চিত হতে নগরীর সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করছে বলে জানিয়েছেন সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার। এছাড়া হোন্ডার পাশাপাশি মাইক্রোটির সম্পৃক্ততাও খতিয়ে দেখার কথা জানিয়েছেন ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণে থাকা গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা।

এদিকে রোববার রাতে পাঁচলাইশ থানার শুলকবহর বড় গ্যারেজ এলাকা থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা মোটর সাইকেলের মালিকের খোঁজ পেয়েছে কি না সে বিষয়ে মুখ খুলছেনা পুলিশ।

তবে মিতু হত্যায় জেএমবির পাশাপাশি শিবিরেরও সম্পৃক্ততা থাকার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন পুলিশ কমিশনার। তবে সুনির্দিষ্টভাবে মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে কিছু বলতে না পারলেও এটির রহস্য উদঘাটনকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নেয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।

উল্লেখ্য, রোববার (৫ জুন) সকালে চট্টগ্রাম নগরের জিইসি মোড়ে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাত ও গুলি করে পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতুকে খুন করে দুর্বৃত্তরা। এঘটনায় সোমবার দুপুরে অজ্ঞাত তিনজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন বাবুল অাক্তার। তবে এ ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তারের কথা জানায়নি পুলিশ। -বাংলামেইল
০৭ জুন, ২০‌১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে