নাসির উদ্দিন রকি: এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার পরিকল্পনাকারী ও কিলিং মিশনের প্রধান হিসেবে মুসা সিকদার ওরফে আবু মুসা এখন আলোচনায়। তাকে আটকের বিষয়টি বরাবরই অস্বীকার করে আসছে পুলিশ। কিন্তু মুসার পরিবার বলছে, মুসা ও তার বড় ভাই সাইদুল ইসলাম সিকদার ওরফে সাকুকে ২২ জুন ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। তারা বিশ্বাস করেন, মুসা ও সাকু এখনও পুলিশ হেফাজতে আছে। মিতু হত্যার মূল হোতাকে বাঁচাতে মুসাকে গুম করা হতে পারে- এমন আশংকা তৈরি হওয়ার পর মুসার স্ত্রী পান্না আক্তার সরকারের কাছে দাবি করেছেন, তার স্বামীকে জীবিত অথবা মৃত ফিরিয়ে দেয়া হোক।
স্বামীর সন্ধানে বৃহস্পতিবার রাঙ্গুনিয়া থানায় জিডি করতে গিয়েছিলেন পান্না। কিন্তু তাকে ফিরে আসতে হয়েছে। মুসার শ্বশুর অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কনস্টেবল ফারুক সিকদার বলেন, সন্ধ্যায় মেয়েকে নিয়ে জিডি করার জন্য রাঙ্গুনিয়া থানায় গিয়েছি। থানার ডিউটি অফিসার পরামর্শ দিয়েছেন, ঘটনা যেখানে ঘটেছে সেই বন্দর থানায় জিডি করার। মুসার পরিবারের এ দাবি সত্য নয় জানিয়ে চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার বলেন, ‘মুসাকে এখন পর্যন্ত আটক কিংবা গ্রেফতার করা হয়নি। তাকে পাওয়া গেলে এ মামলার গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই বের হয়ে আসবে। মুসাসহ মিতুর অন্য খুনিরা যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারে সেজন্য বিমান, নৌ ও স্থলপথে তাদের ছবি দিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। যখন যাকে এ মামলায় আটক কিংবা গ্রেফতার করা হবে তখনই তাকে আপনাদের (সাংবাদিকদের) সামনে হাজির করা হবে।’ এখন প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশ মুসাকে আটক না করে থাকলে মুসা গেল কোথায়?
মুসাকে আটকের বর্ণনা স্ত্রীর : বৃহস্পতিবার পান্না আক্তার বলেন, ‘২২ জুন সকাল ৭টায় আমি, ভাসুর সাইদুল ইসলাম সিকদার ওরফে সাকু এবং আমার দু’ছেলে ফামির সিকদার (১২) ও ছোট ছেলে সানজু সিকদারকে (৯) নিয়ে বন্দর থানাধীন নূরনবীর বাসায় বেড়াতে যাই। সেখানে গিয়ে বুঝতে পারি পুলিশ নূরনবীকে দিয়ে আমাদের সেখানে নিয়েছে। নূরনবী মাইক্রোবাস চালক। তার মাইক্রোবাসে আমরা বেড়াতে যাই। এছাড়া নূরনবী আমার স্বামীর ব্যবসার কাজও করত।’ পান্না বলেন, ‘ওইদিন নূরনবীর বাসায় যাওয়ার পর পুলিশ আমাদের সবাইকে জিম্মি করে ফেলে। একপর্যায়ে পুলিশ নূরনবীকে দিয়ে মুসাকে ফোন করে। মুসাকে আসতে বলে নূরনবী ও সাইদুলকে কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিয়ে যায়। আর কয়েকজন পুলিশ সদস্য আমাদের সামনে ছিল। কিছুক্ষণ পর এক মহিলা পুলিশ এসে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। মুসা সম্পর্কে বিভিন্ন কথা জানতে চান। এর ঘণ্টাখানেক পর আগের জিজ্ঞাসাবাদকারী ওই পুলিশ কর্মকর্তার কাছে মুসাকে গ্রেফতারের খবর জানিয়ে ফোন আসে। ওই পুলিশ কর্মকর্তাও আমাকে বলেন মুসাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’
পান্না আরও বলেন, ‘ওই পুরুষ পুলিশ কর্মকর্তার চেহারা চাকমাদের মতো দেখতে। মাথার সামনে চুল কম। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়ও আমার সঙ্গে ওই পুলিশ কথা বলেছেন। ভোলাকে যখন গ্রেফতার করা হয় তখন টিভিতে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে দেখেছি। আজ এক সপ্তাহ পার হলেও আমার স্বামী ও ভাসুরকে আদালতে হাজির করা হচ্ছে না। তারা বেঁচে আছে নাকি তাদের মেরে ফেলা হয়েছে তাও জানতে পারছি না। কয়েক দিন ধরে স্বামী যাতে আমাদের মাঝে ফিরে আসে সেজন্য মাজারে মাজারে ঘুরছি। কয়েকটি পত্রিকায় দেখলাম আমার স্বামীকে নাকি গুম করে ফেলা হয়েছে।’
পান্না বলেন, ‘আমার স্বামী যদি দোষ করে থাকে তাহলে আইনগতভাবে তার বিচার হোক। স্বামী কি দোষ করেছে তা জানার আগেই তাকে যদি (মুসা) মেরে ফেলা হয়, তাহলে সত্য উদঘাটন হবে না।’
এসপি বাবুল আক্তারকে আগে তিনি চিনতেন কিনা? এমন প্রশ্নে পান্না বলেন, ‘তাকে (বাবুল আক্তার) সরাসরি আমি কখনও দেখিনি। তার সঙ্গে আমার কখনও কথাও হয়নি। তার স্ত্রী খুন হওয়ার পর পত্রিকা-টিভিতে তার ছবি দেখেছি। আমার স্বামী পুলিশের সোর্স ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্বামীকে (মুসা) ফেরত দেয়ার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করছি। যদি মেরে ফেলা হয় তাহলে লাশটা হলেও আমাদের দিয়ে দিক।’ পান্না আক্তার চট্টগ্রাম শহরের বাসায় তালা লাগিয়ে ৪ দিন আগে উঠেছেন রাঙ্গুনিয়া উপজেলার শিলক ইউনিয়নের কাটাকালি এলাকার বাবার বাড়িতে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. কামরুজ্জামান বলেন, মুসাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে এ হত্যার সঙ্গে জড়িত কালু, রাশেদ, নবীসহ অন্যদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।
তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন আমরা নগরী এবং জেলার বিভিন্ন স্থানে মুসাসহ কিলারদের খোঁজে অভিযান চালাচ্ছি। পুলিশের তিনটি টিম তাদের গ্রেফতারে কাজ করছে। আশা করছি শিগগিরই মুসাসহ বাকি কিলারদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হব। শুক্রবার রাতে এসপি বাবুল আক্তারকে ঢাকায় শ্বশুর বাড়ি থেকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নেয় পুলিশ। সেখানে ১৫ ঘণ্টা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে এ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘গ্রেফতার হওয়া আসামিদের বাবুল আক্তারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদ নয়, আসামিদের শনাক্ত করতে বাবুল আক্তারকে ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়।’ কিন্তু শুক্রবার পর্যন্ত কোনো আসামিকে গ্রেফতারের তথ্য দেয়নি পুলিশ। আদালতে জবানবন্দি দেয়া ওয়াসিম ও আনোয়ার হোসেনকে শনিবার রাতে গ্রেফতার করা হয় বলে রোববার সংবাদ সম্মেলন করে জানান সিএমপি কমিশনার।
এ নিয়ে তাই প্রশ্ন উঠেছে, বাবুল আক্তারকে কার মুখোমুখি করা হয়েছিল মুসার? জবানবন্দিতে ওয়াসিম ও আনোয়ার বলেন, মিতুকে হত্যার ১৫ দিন আগে ওয়াসিম, নবী, কালু, শাহজাহানসহ সাতজনকে নিয়ে পরিকল্পনা করেন মুসা। ঘটনার আগের দিন রাতে তারা সবাই মুসার বাসায় ঘুমান। ওই দিন মুসা সবাইকে ৫০০ টাকা করে দেন। ঘটনার পর তারা আবার মুসার বাসায় যান। সেদিন মুসা সবাইকে এক হাজার টাকা করে দেন। সেখান থেকে যে যার মতো চলে যান।
বেনাপোল ইমিগ্রেশনে সতর্কতা : যশোরের বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট ইমিগ্রেশন ও সীমান্তে বৃহস্পতিবার বাড়তি সতর্কতা জারি করেছে বেনাপোল চেকপোস্ট ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। মিতু হত্যায় জড়িত সন্দেহভাজন পাঁচজন যাতে কোনোভাবেই দেশ ত্যাগ করতে না পারে সে লক্ষ্যে এ সতর্কতা জারি করা হয়। প্রত্যেক পাসপোর্টধারী যাত্রীকে যাচাই-বাছাই করে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরেই তাদের যাতায়াতের অনুমতি দিচ্ছে চেকপোস্ট কর্তৃপক্ষ। বহির্গমন ডেস্ক অফিসারদের সামনে সন্দেহভাজনদের ছবি সেঁটে দেয়া হয়েছে। চেকপোস্ট ইমিগ্রেশনের ওসি ইকবাল মাহমুদ জানান, আমরা সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছি।-যুগান্তর
১ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ