ঢাকা ও চট্টগ্রাম: পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কার্যকর অগ্রগতির সংবাদ নেই। নানামুখী আলোচনা, গুঞ্জন ও সন্দেহ বেড়েই চলেছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের আচরণে রহস্যজট আরো বাড়ছে। পুলিশেরই নানা মন্তব্য ও আচরণে চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্ত নিয়ে রীতিমতো সংশয় ও সন্দেহ দানা বেঁধে উঠেছে। এসপি বাবুলকে কেন দীর্ঘ সময় ডিবি অফিসে আটকে রাখা হয়েছিল, তিনি সন্দেহের বাইরে আছেন কি না, তাঁকে ইস্তফার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে কেন, কী উদ্দেশ্যে ও কারা মিতুকে হত্যা করেছে তা জানতে চাইলে স্পষ্ট জবাব মিলছে না। নানামুখী গুঞ্জনের জন্য গণমাধ্যমের ওপর দায় চাপাচ্ছেন তাঁরা।
পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, মিতু হত্যাকাণ্ড নিয়ে মিডিয়ায় যেসব খবর আসছে তা বোগাস, এর লেশমাত্র সত্যতা নেই। মিতু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বাবুল আক্তার জড়িত, তা আমরা বলিনি। অথচ মিডিয়া বলে দিচ্ছে বাবুল আক্তারের দিকে সন্দেহের তীর। যেকোনো মামলার বাদীকে যেকোনো সময় তদন্তকারী সংস্থা ডাকতেই পারে। তবে এ মামলায় কিলারদের ধরা হয়েছে, তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। আশা করি অল্প সময়ের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী কে তা দেশবাসী জানতে পারবে।
এদিকে মিতু হত্যায় আদালতে স্বীকারোক্তি দেওয়া আসামিদের বক্তব্যে বেশ কিছু গরমিল পাওয়া যাচ্ছে। আসামি মোতালেব মিয়া ওয়াসিম জবানবন্দির এক স্থানে বলেছেন, ‘ওই মহিলা (মিতু) জঙ্গিদের অর্থদাতা। সে সারা ওয়ার্ল্ডে যায়।’ ‘নবী পেছনের দিক দিয়া গিয়া মহিলাকে ছুরি মেরে দিল, মহিলা দৌড় দিতে চাইল। কালু ধাক্কা দিল। আমি ওখানে গিয়ে ওপরের দিকে ফাঁকা গুলি করি। মহিলা রাস্তার ওপর পড়ে গেল। কালু মহিলাকে ছুরি মারে। নবী ছাড়া আমাদের সবাইকে মুসা বলে, নবী যদি ধরা পড়ে তখন কাউকে না যেতে। যাতে নবী গণপিটুনিতে মারা যায়।’
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, খুনের ঘটনায় মুছা, নবী ও ওয়াসিম সরাসরি জড়িত ছিল। কিন্তু ওয়াসিমের স্বীকারোক্তিতে জানা গেছে, কালু নামে আরেকজন ছিল। নবী ও কালু দুজনই মিতুকে ছুরিকাঘাত করেছে। ওয়াসিমের দাবি, তার কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে মুসা মিতুর মাথায় গুলি করেছে। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ওয়াসিম খুনের মামলায় জেলখাটা আসামি। এ কারণে জবানবন্দিতে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেছে। নিজে গুলি চালালেও সেটি ফাঁকা বলে দাবি করেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওয়াসিমই মিতুর মাথায় গুলি করেছে এবং তার গুলিতেই মিতুর মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে।’
পুলিশের এই কর্মকর্তা আসামি আনোয়ারের স্বীকারোক্তি উদ্ধৃত করে বলেন, ‘কালু ও শাহজাহানকে নিরিবিলি হোটেলের নিচে থাকার নির্দেশনা দিয়েছিল মুছা। কালু যদি হোটেলের নিচে থাকে, তাহলে মিতুকে সে ছুরিকাঘাত করেছে কিভাবে?’ দুই আসামির স্বীকারোক্তি পর্যালোচনার পর পুলিশের দাবি, ওয়াসিম নিজেকে বাঁচাতে কিছু অসত্য তথ্য দিয়েছে। সে-ই মিতুর মাথা লক্ষ্য করে গুলি করেছে। ছুরিকাঘাতের সময় কালু ছিল কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অন্য আসামিদের মাধ্যমে তা জানা যেতে পারে।
ধোঁয়াশা পরিকল্পনাকারী নিয়ে : কার পরিকল্পনায় মিতুকে হত্যা করা হয়েছে, পুলিশ একপর্যায়ে তা জেনে গেছে বলে দাবি করেছিল। কিন্তু নানামুখী গুঞ্জন ও সন্দেহ দানা বাঁধলেও তা প্রকাশ করা হচ্ছে না। মূলত তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই একের পর এক বিভ্রান্তি ছড়িয়ে মামলাটি ভিন্নখাতে নিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ বিস্তর। মিতুর পরিবার থেকেও এ রকম অভিযোগ করা হয়েছে। মধ্যরাতে বাবুল আক্তারকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে টানা ১৫ ঘণ্টা আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ অনেক প্রশ্ন তৈরি করেছে। কিন্তু সেসব বিষয় এড়িয়ে গিয়ে কর্মকর্তারা দায়সারা বক্তব্য দিচ্ছেন। বাবুল আক্তার নিজেও কিছু বলছেন না স্পর্শকাতর এ বিষয় নিয়ে। এসপি বাবুল আক্তারের যে সোর্সের মাধ্যমে এ হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়ন হয়েছে বলে পুলিশের দাবি, সেই মুছা সিকদারের অবস্থান নিয়েও চলছে লুকোচুরি। পুলিশের কবজাতেই মুছা আছে বলে পরিবারসহ অনেকের দাবি। কিন্তু পুলিশ তা অস্বীকার করলেও মুছাকে গ্রেপ্তারে দৃশ্যমান কোনো প্রচেষ্টা নেই।
পুলিশের সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে পুলিশই তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। রাতের বেলায় বাসা থেকে এনে বাদীকে এভাবে জিজ্ঞাসাবাদ ঠিক হয়নি। একজন পুলিশ সুপারকে দীর্ঘসময় জিজ্ঞাসাবাদ নানা প্রশ্নের জন্ম দিতেই পারে। সে বিষয় পরিষ্কার করা উচিত তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। খুনিদের স্বীকারোক্তিসহ যেভাবে খুনের বর্ণনা প্রচার পেয়েছে, তাতে গ্রেপ্তার সম্ভব না হলেও পরিকল্পনাকারীদের নাম প্রকাশ করা জরুরি। না হলে পুলিশকে বদনামের মধ্যেই থাকতে হবে, মামলার প্রকৃত রহস্য আড়ালেই চলে যাবে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাবুল আক্তারকে চাপ দিয়ে পদত্যাগপত্র নেওয়া হয়েছে বলে গণমাধ্যমে এসেছে। কিন্তু বাবুল যদি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকেন, তাহলে চাকরি তো এমনিতেই থাকবে না। আর সন্দেহ না থাকলে তাঁকে কেনই বা এভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। পুলিশ বিভাগের ভেতরের কোনো বিরোধ এসব প্রচারণা ও সন্দেহের জন্ম দিতে পারে।’ গত ৫ জুন ভোরে ছেলে মাহিরকে স্কুলে নেওয়ার পথে চট্টগ্রামে জিইসির মোড়ে খুন হন এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। মামলার বাদী বাবুল আক্তার। এ মামলায় পুলিশ ছয়জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। তাদের মধ্যে আবু নছর গুন্নু ও রবিন নামে দুজন ঘটনায় জড়িত নয় বলে তদন্তসংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন। অন্যদের মধ্যে ওয়াসিম ও আনোয়ার নামে দুজন আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। হত্যায় অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে অভিযুক্ত এহতেশামুল হক ভোলা ও মনির হোসেন নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।-কালের কন্ঠ
১ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ