আলম দিদার: আক্তার মাহমুদ মাহির ও আক্তার তাবাসসুম নিখাদ। পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তার ও মাহমুদা খানম মিতু দম্পতির দুই সন্তান। বড় ভাই মাহিরের বয়স সাত বছর আর ছোট বোন তাবাসসুম সাড়ে চার বছরের। আজকের ঈদটি সবার জন্য আনন্দের হলেও তাদের জন্য বেদনার, শূন্যতার। এই প্রথম তাদের মাকে ছাড়া ঈদ উদযাপন করতে হচ্ছে।
প্রতি ঈদে তাদের মা সকালে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে গোসল করিয়ে নতুন পোশাক পরিয়ে সাজিয়ে দিলেও এবার মায়ের সেই আদর পাচ্ছে না শিশু দুটি। এসব কাজ করতে হয়েছে পিতা বাবুল আক্তারকেই। কেন না তিনিও হারিয়েছেন তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে। ১৪ বছরের সংসার জীবনে এই প্রথম তাকেও স্ত্রী মিতুকে ছাড়া ঈদ উদযাপন করতে হচ্ছে। ঈদ সবার জন্য আনন্দের বার্তা নিয়ে এলেও তার পরিবারের জন্য কষ্ট ফেরি করে এনেছে এই ঈদ!
গত এক মাস ধরে মাকে ছাড়া বাবার সঙ্গে ঢাকার খিলগাঁওয়ের নানার বাসায় এই দুই শিশুসন্তান আছে। ছোট্ট তাবাসমুম বাবার কাছে জানতে চায়, ঈদের দিনেও কি মা আসবে না? তখন পাশে থাকা বড় ভাই মাহির বোনকে বলে, মা আকাশে আছে আল্লাহর কাছে, স্বর্গে আছে। তখন তাবাসসুম বায়না ধরে ঈদ করতে বাবা ও ভাইকে নিয়ে সেও স্বর্গে যাবে!
সন্তানের এমন বায়নায় বুক ফেটে যায় বাবুল আক্তারের। মায়ের সঙ্গে দেখা করাতে তাদের স্বর্গে নেয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে দুই সন্তানকে বুকে টেনে নেন বাবা বাবুল।
নিজ চোখে মাকে নির্মমভাবে খুন হতে দেখেছে মাহির। আর সেই থেকে ট্রমা কাটাতে মাহিরকে মনোচিকিৎসকের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মাহিরের মা আল্লাহর কাছে চলে গেছেন। তিনি স্বর্গের বাসিন্দা এবং সেখানে খুব সুখে-শান্তিতে আছেন। এমনকি প্রতিরাতে তাদের ঘুমের সময় এসে দেখে যান।
গত ৫ জুন সকালে নিজ বাসার অদূরে চট্টগ্রাম নগরীর ও আর নিজাম রোডে দুর্বৃত্তদের হাতে নির্মমভাবে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। এ ঘটনার মোটিভ উদ্ধার করতে না পারলে পুলিশ সন্দহভাজন ছয় ভাড়াটে খুনিকে গ্রেপ্তার করে জেলে পুরেছে। ইতোমধ্যে আরও দুজন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে।
ওই ঘটনার পর থেকে ঢাকার খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়ার ভূইয়াপাড়ার শ্বশুরের বাসায় দুই সন্তানকে নিয়ে থাকছেন বাবুল আক্তার। গত ২৫ জুন তাকে রাতে ডিবি কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে ১৫ ঘণ্টা বসিয়ে রেখে বাসায় ফেরত পাঠানোর পর স্ত্রী হত্যার জন্য তাকে দায়ী করে অনেক গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তবে সেই ঘটনার পর থেকে চাকরিতেও ফেরেননি বাবুল আক্তার এবং নিজেই গৃহবন্দির মতো দিনযাপন করছেন।
বাংলামেইলের অনুরোধে সরাসরি কথা বলতে রাজি না হলেও পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন বাবুল আক্তার।
সেই সূত্রের বরাতে বাবুল আক্তার তার ঈদ উদযাপনের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘আমার ১৪ বছরের সংসার জীবনে কোনো ঈদের সময় আমি পরিবারের বাইরে ছিলাম না। ছুটি না পেলেও অন্ততপক্ষে মিতুর সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতাম। প্রতি ঈদের পোশাক মিতুই রমজানের শুরুতে কিনে ফেলত। আমি চাকরির জন্য সময় পেতাম না বলে সেই ঘর সংসার পরিবার সামলাতো। আমাদের জন্য ছাড়াও মিতুর বাবার বাড়ির সকলের জন্য এবং আমার পরিবারের সকলের জন্য পোশাক কিনত সেই। এ ছাড়া এলাকার অসহায় মানুষদেরও সেমাই ও ঈদের নতুন জামা কিনে দিত মিতু।’
ঈদের দিনের কথা বলতে গিয়ে বাবুল আক্তার বলেন, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বাচ্চাদের গোসল থেকে শুরু করে নতুন কাপড় পরিয়ে রেডি করত। এরপর বিকেলে আমরা সকলে আত্মীয়দের বাসায় বেড়াতে যেতাম। আমার জন্য প্রতি বছরই সে নিজের পছন্দের একটি পাঞ্জাবি কিনত। নতুন টাকা বিলি করা মিতুর শখ ছিল। সে প্রতি ঈদে মাহির-তাবাসসুমকে ছাড়াও এলাকার বাচ্চাদের নতুন টাকা দিয়ে সেলামি দিত।’
নিজের পছন্দের খাবার এ বছর আর খাওয়া হবে না জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমার প্রিয় খাবার হচ্ছে গরুর মাংস ও খিচুড়ি। মিতু এগুলো ঈদের দিন সাত সকালে উঠেই রান্না করে রাখত। নামাজ শেষে আসার পর আমাকে নিজ হাতে পাত্রে তুলে দিত। তবে মেহমানদের জন্য পায়েশ-সেমাই নুডুলসসহ অন্যান্য খাবার তৈরি করত। কিন্তু এবার মিতু না থাকায় সেই প্রিয় খাবারও খাওয়া হয়নি।’
গত ১৪ বছর ধরে ঈদ শপিং স্ত্রী করায় এবার পাঞ্জাবিও কেনা হয়নি বাবুল আক্তারের। এমনকি বাচ্চাদের জন্যও কেনেননি কিছু। তবে স্বজনরা তাদের জন্য নতুন পোশাক উপহার দিয়েছেন।
১৪ বছরের সংসার জীবনে এই প্রথম স্ত্রী মিতুকে ছাড়া ঈদ উদযাপন করাকে নিজের জীবনের সবচেয়ে কষ্টের দিন বলে মন্তব্য করেছেন আলোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, ‘আজকের ঈদ সবার জন্য খুশির ও আনন্দের হলেও আমার জন্য ও আমার দুই সন্তানের জন্য সবচেয়ে কষ্টের দিন। মিতুকে ছাড়া ঈদ কল্পনাই করতে পারছি না। বাচ্চারা তাদের মাকে খুঁজছে। তাদের মা স্বর্গে এটি বলার পর তারাও মায়ের সঙ্গে ঈদ করতে স্বর্গে যেতে আবদার করছে। এই অবুঝ সন্তানদের এই আবদার কীভাবে পূরণ করব?’ এ সময় নিজের বুক ফেটে কান্না আসলেও সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে চেপে রাখতে হয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাবুল আক্তার বলেন, ‘গত ঈদের সময় আমি মিশনে ছিলাম। এরপরও সে সব কিছু সামলে নিয়েছিল। ঈদের পনের দিন আগে ছুটিতে আসি। সুদান থেকে সরাসরি বিমানবন্দর নেমে গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। সেখানে মিতুর সঙ্গে ঈদ উদযাপন করি। মিতু তার কাজ দিয়ে আমাদের পরিবারের মধ্যমণি হয়ে উঠেছিল। সবার কাছে সে পুত্রবধূর পরিচয় ছাপিয়ে বাড়ির মেয়ে হয়ে উঠেছিল।’
সেই মেয়েকে হারিয়ে শোকে যেমন স্তব্ধ মিতুর মা-বাবা। ঠিক তেমনি বাবুলের মা-বাবাও। সেজন্য নাতি-নাতনিদের সঙ্গে ঈদ করতে মাগুরা থেকে বাবুলের শ্বশুরবাড়িতে চলে এসেছেন তার মা-বাবাও। সেখানে মা-হারা দুই নাতিকে সঙ্গ দিচ্ছেন তারা।
জানা যায়, ঈদের দিনে সকালে ঘুম থেকে উঠে বাচ্চাদের প্রস্তুত করিয়ে ঈদগাহে যান তারা। এরপর ঈদের জামাত আদায় শেষে মাহমুদা খানম মিতুর কবর জেয়ারতের পর বাসায় এসে মাহির ও তাবাসসুমকে নিয়ে খলতে বসেন বাবুল আক্তার। তবে মিতুর জন্য পরিবারের সবার চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছিল বলে জানা গেছে। কে কাকে সান্ত্বনা দেবেন ভেবে পাচ্ছেন না কেউ। আত্মীয়-স্বজনরাও শোকাবহ এ পরিবেশে এসে তাদের স্বান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেন।-বাংলামেইল
৭ জুলাই ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এইচএস/কেএস