এম আই চৌধুরী, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড থেকে আটক আনসার উল্ল্যাহ বাংলা টিমের (এবিটি) চার জঙ্গির কাছ থেকে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
ঢাকার গুলশানের মতো চট্টগ্রামেও ভয়াবহ নাশকতার পরিকল্পনায় উপজেলার বাড়বকুন্ডে আস্তানা গড়ে তুলেছিলেন জঙ্গিরা। আটক চার জঙ্গির মধ্যে রয়েছেন ধর্মান্তরিত পটিয়ার ছনহরা গ্রামের পিকলু দাশ।
নিষিদ্ধ ঘোষিত এ জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়ে নাম দেন মুসায়াব ইবনে উমায়ের। সে পোশাক প্রস্তুককারক প্রতিষ্ঠান ইয়াং ওয়ানে চাকরি করলেও আড়ালে যুক্ত ছিলেন জঙ্গি সংগঠন এবিটির সঙ্গে।
এদের মধ্যে উমায়েরের ব্যাপারে অনুসন্ধানে জানা যায়, হিন্দু থাকাবস্থায় জঙ্গি উমায়ের তার কলেজের এক মুসলিম মেয়ের প্রেমে পড়ে ধর্মান্তরিত হয়ে জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেন ওমায়ের।
২০১১ সালে বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার এক মাস পর তার পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে একটি ডায়রির ১ম পাতায় লেখা ছিল, মালিক আল্লাহ, ২য় পাতায় লেখা আছে হ্যাপী নামের মুসলিম এক মেয়েকে আমি ভালোবাসি। তাকে বিয়ে করার জন্য আমি মুসলিম হয়ে যাব। এরপর তাকে অনেক দিন ধরে খোঁজাখুঁজি পরও তার মা বাবা আর খুঁজে পায়নি।
জঙ্গি মুছা ইবনে উমায় সাবেক পিকলু দাশের বিষয়ে তার মা ঝর্না রানী দাশ (৪৫) জানান, ১৯৯০ সালে ডিসেম্বর মাসে পিকলু দাশ পটিয়া উপজেলা ছনহরা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড নিজ বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের ৬ মাস পর গ্রামের বাড়ি ছেড়ে পটিয়ায় বাসা নিয়ে তার পরিবার বসবাস করে আসছে।
এর কিছুদিন পর তার বাবা অরুন কান্তি দাশ চট্টগ্রাম নগরীর রিয়াজউদ্দীন বাজার এলাকায় ব্যবসা করার কারণে তারা স্বপরিবারে চট্টগ্রাম নগরীতে ভাড়ার বাসায় চলে আসে। ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম রেলওয়ারী সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে পিকলু দাশ এবং চট্টগ্রাম ইসলামী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে সে।
তিনি জানান, ২০১০ সালের শেষের দিকে আমাদের ভাসায় পিকলুর সঙ্গে ৩ জন বন্ধু আসা যাওয়া করতো তারা ৪ জন মিলে দরজা বন্ধ করে প্রয়ে ২-৩ ঘণ্টা বন্ধ রুমে কী করত আমি জানতাম না। এইভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর আমি পিকলুকে জিজ্ঞাস করলাম এরা কারা, জবাবে পিকলু বললেন এরা আমার কলেজের বন্ধু, আমি বললাম এরা কী মুসলিম পিকলু বলল হ্যাঁ, এরা আমার কলেজের মুসলিম বন্ধু।
এভাবে প্রায় একমাস যাবৎ এই তিন বন্ধু বাসায় আসে। এরপর হঠাৎ করে ২০১১ সালে জানুয়ারি মাসে বাসায় কিছু না বলে পিকলু চলে যায়। চলে যাওয়ার দুইদিন পরে এসে আমাকে পিকলু বলে মা ভাত আছে। আমি ছেলেকে বলি ভাত আছে। পিকলু কৈ মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে সেই যে চলে গেল আর ফিরে আসে নাই, আমাদের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ ছিল না তার সঙ্গে।
২০১১সালে পিকলু চলে যাওয়ার একমাস পর তার পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে আমি একটি পিকলু লেখা ডায়রি পাই। ডায়রির ১ম পাতায় লেখা ছিল মালিক আল্লাহ, ২য় পাতায় লেখা আছে হ্যাপী নামের মুসলিম এক মেয়েকে আমি ভালবাসি। তাকে বিয়ে করার জন্য আমি মুসলিম হয়ে যাব। কিন্তু ডায়রির কোনো পাতায় লেখা ছিল না সে জঙ্গি হয়ে যাবে। এর পর অনেক দিন ধরে খোঁজাখুঁজি করে তাকে আমরা পায়নি। এরপর গত ২ বছর আগে আমরা স্বপরিবারে পটিয়া উপজেলা ছনহরা গ্রামে চলে আসি।
তার মা কাঁদতে কাঁদতে আরো বলেন, পিকলু ছাড়া আমার দুই মেয়ে এক ছেলে রয়েছে। ওর বাবা ছাড়া আমাদের সংসার চালানোর মতো আর কেউ নাই। ছেলে মুসলিম হওয়ার খবর শুনে বর্তমানে তার বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত। ওর যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমাদেরকে না খেয়ে মরতে হবে।
পিকলুর মা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন যে ছেলেকে ১০ মাস ১০ দিন পেটে ধরেছি সে ছেলে যদি জঙ্গি হয়ে যায় ও আমাদেরকে ছেড়ে মা-বাবাকে ভুলে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে আমরা তাকে চিনি না। তার সঙ্গে আমাদের কোনো সর্ম্পক নাই। দীর্ঘ ৫ বছর কোনো যোগাযোগ ছিল না। যারা আমার ছেলেকে জঙ্গি বানিয়েছে এই সব কথা যদি বলি তারা আমাদেরকে মেরে ফেলতে পারে। তাই আমাদের পরিবার সদস্যরা কেউ ভয়ে মুখ খুলছি না।
এদিকে আটক হওয়ার পর হামলার পরিকল্পনার বিষয়ে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে জঙ্গিরা। রাষ্টয়ত্ব রাসায়নিক কারখানা কেমিকেল কমপ্লেক্সে দায়িত্বরত ২৫জন চীনা নাগরিক ও থানা এবং পুলিশ সদস্যর ওপর হামলার বিষয়ে পরিকল্পনা করছিলেন নিষিদ্ধ ঘোষিত এ সংগঠনের জঙ্গিরা।
এদিকে এ ঘটনার পর প্রতিষ্ঠানের ভেতরে দায়িত্বরত চীনা নাগরিকের নিরাপত্তা জোরদারে সর্তক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। কেমিকেল কমপ্লেক্সে জঙ্গি হামলার পরিকল্পনাকারী চার জঙ্গি আটকের পর ইতিমধ্যে সীতাকুল্ডের অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিদেশি নাগরিকের নিরাপত্তার বিষয়ে তৎপর রয়েছে উপজেলা প্রসাশন।
এ বিষয়ে বাড়বকুন্ড ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্ল্যাহ মিয়াজী বলেন, বাড়বকুন্ড মান্দারীটোলা এলাকার জয়নাল আবেদীন জুনুর ছেলে রাজীব কেমিকেল কমপ্লেক্সের পার্শ্ববর্তী তার পাহাড়ে জঙ্গিদের আস্তানা করে দেওয়ার অভিযোগ উঠলেও অভিযান চলাকালে তাকে পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।
সীতাকুন্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.নাজমূল ইসলাম ভূঁইয়া জানান, সীতাকুন্ডে অনেকগুলি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠানে কতজন বিদেশি নাগরিক রয়েছে তার সঠিক তথ্য আমাদের কাছে নেই। এ ঘটনার পর উপজেলার প্রতিটি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বিদেশি নাগরিকের বিষয়ে সুনিদিষ্ট তথ্য দিতে বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশকিছু তথ্য পাওয়া গেছে। পুরোটা পেলে বিদেশিদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যবস্থা নিতে তালিকা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।
সীতাকুন্ড মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইফতেখার হাসান বলেন, বাড়বকুন্ড থেকে জঙ্গি আটকের পর থেকে কেমিকেল কমপ্লেক্সে কর্মরত চীনা নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কড়া পাহারায় রয়েছে পুলিশ। এ ঘটনার পর পুলিশ একাধিকবার কারখানা পরিদর্শন করেছে। বিদেশি নাগরিকের নিরাপত্তা রক্ষায় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নিরাপত্তা প্রহরীকে বেশ কিছু দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামে সীতাকুন্ড থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের চার সদস্যকে আটক করা হয়েছে। আটক চারজনের মধ্যে সংগঠনটির বায়তুল মাল সম্পাদক মুছা ইবনে উমায়ের (২৫) সাবেক পিকলু দাশ,মো. শিপন ওরফে ফয়সাল (২৫), খোরশেদ আলম (৩১) ও রাসেল মো. ইসলাম (৪১)। এ চারজনকেই রোববার রাতে আটক দেখিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার একেএম হাফিজ আক্তার। - পূর্বপশ্চিম
১২ জুলাই, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম