আমান উল্লাহ আমান, টেকনাফ থেকে : মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিদের ধরে চোখ বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। অনেককে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। ফলে গ্রামে মিলিটারিদের সঙ্গে কথা বলে এমন ব্যক্তি পর্যন্ত নেই। জ্বালিয়ে দিয়েছে তাদের বাড়িঘর। ক্ষেতের ধান বিলে পেকে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। খাবারের তীব্র সংকট চলছে।
ফলে ঘরবাড়ি ছাড়া খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে মিয়ানমারের মুসলিমদের। এমন যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সপরিবারে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ছাড়া বিকল্প কোনো রাস্তা খোলা ছিল না বলে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা জানায়।
মিনারা বেগম (২২)। দুই চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছে। কিছুতেই বিলাপ কান্না থামছেই না। সে মিয়ানমারের মংডুর রাইম্যাবিল এলাকার মো. ছলিমের স্ত্রী। গত ২০শে নভেম্বর দালালের মাধ্যমে জাদীমোরা সীমান্ত দিয়ে রাতে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।
খবর পেয়ে এ প্রতিবেদক মিনারা বেগমের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, তার স্বামী ছলিমকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী চোখ বেঁধে নিয়ে গেছে। চোখের সামনে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। অকাট্য ভাষায় গালমন্দ করেছে সেদেশের মিলিটারি বাহিনী। নির্যাতন করা হয়েছে প্রতিবেশীসহ আত্মীয়স্বজনকে। স্বামীকে চোখ বাঁধা অবস্থায় লাথি, ঘুষি, বন্দুকের বাঁটের আঘাতসহ অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। তার এলাকার দুই তৃতীয়াংশ বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে ছাই করে দিয়েছে। মাথা গোঁজার কোনো স্থান নেই। সেই সঙ্গে বিলের ধান পেকে ঝরে গেছে। পুরুষবিহীন এলাকায় থমথমে অবস্থা। খাদ্যাভাবে ক্ষুদার জ্বালায় অবশেষে বাংলাদেশে মাতৃভূমি ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছি।
তেমনিভাবে কথা হয় ছোট গউজিবিলের নাদির হোছনের ছেলে ফেরদৌসের (২৬) সঙ্গে। গত বছর এই সময়ে বিবাহ করে সুন্দর সংসার চলছিল। হঠাৎ করে নেমে আসে রাষ্ট্রবাহিনীর অমানবিকতা। কোনো রকমে অন্যদের সঙ্গে পাহাড়ে, খালে ও বিলে লুকিয়ে লুকিয়ে নির্যাতন থেকে এতদিন বেঁচে আছি। কিন্তু মিলিটারির এলোপাতাড়ি গুলিতে সঙ্গীয় কয়েকজনের প্রাণহানি হওয়ায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে প্রাণ বাঁচাতে সেও নতুন বউ তছলিমাকে নিয়ে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নেয় লেদা রোহিঙ্গা টালে (বস্তি)।
মাও. মো. জোহার (৩৫) জানান, গত ১০ই অক্টোবর থেকে মিয়ানমার বাহিনী মুসলিমদের উপর চরম নির্যাতন চালিয়ে আসছে। সুন্দরী যুবতী মহিলাদের ধরে (প্রকাশ অযোগ্য শব্দ) করা করছে। তার পরিবার থেকে চারজনকে নিয়ে গেছে। তন্মধ্যে চাচা খুইল্যা মিয়া, এক ভাই বায়তুল্লাহ, ২ বোন রফিকা ও নুর সাহিনা। ১৪ দিন পার হলেও তাদের হদিস এখনো পায়নি। তারা কি বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে তাও জানা নেই তার। রাতের বেলায় গ্রামে ঢুকে অস্ত্রের মুখে (প্রকাশ অযোগ্য শব্দ) করা হচ্ছে সুন্দরী মহিলাদের। পুরুষদের পেলে নির্যাতন ও চোখ বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন প্রতিনিয়ত।
মো. ইদ্রিছ (৩৮) জানান, গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিদের ধরে চোখ বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। অনেককে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। ফলে মিলিটারিদের সঙ্গে কথা বলে গ্রামে এমন ব্যক্তি পর্যন্ত নেই। ক্ষেতের ধান বিলে পেকে গিয়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। খাবার তীব্র সংকট চলছে। ফলে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে মিয়ানমারের মুসলিমদের। এমন যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সপরিবারে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ছাড়া বিকল্প কোনো রাস্তা খোলা ছিল না।
এভাবে বিভিন্ন এলাকার অনেকের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। সবারই মুখে চোখে এক ধরনের আতঙ্কভাব। কিছু জিজ্ঞেস করতেই বিলাপ সুরে কান্না। কারো সন্তান, কারো ভাই, কারো স্ত্রী, কারো বাবা হারানোর আর্তনাদ। তাদের সেই আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। তাদের বর্ণনায় এমন কোনো নির্যাতন বাকি নেই যা মিয়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গাদের করা হয়নি। বিশেষ করে মিলিটারি বাহিনী কর্তৃক মহিলাদের উপর জুলুম কিংবা (প্রকাশ অযোগ্য শব্দ) ঘটনাটি এখন বেশি হচ্ছে।
তারা জানায়, গত ৯ই অক্টোবর দুর্বৃত্তরা বিজিপি ক্যাম্পে হামলার ঘটনার পর থেকে তাদের উপর এ নির্যাতন শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ছোট গউজিবিল ও বড় গউজিবিল গ্রামের সকল বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া রাবাইল্যা, ফৌখালী, কেয়ারিপ্রাং, চালিপ্রাং ও ওয়াবেগ গ্রামের অনেক বাড়িও পুড়িয়েছে। তাদের সেই সকল নির্যাতন থেকে বাঁচতে দলে দলে মুসলিম রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে।
টেকনাফ ২ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) অতিরিক্ত পরিচালক আবু রাসেল ছিদ্দিকী জানান, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিহত করতে সীমান্তে টহল জোরদার রয়েছে। ইতিমধ্যে অসংখ্য রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা প্রতিহত করেছি। আজকের এ রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেনি বলেও জানান তিনি। এমজমিন
২৬ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি