হুমায়ুন কবির জুশান উখিয়া (কক্সবাজার): উখিয়া সদর স্টেশন জামে মসজিদের পাশে দেয়াল ঘেঁষে বসে আছে চারটি রোহিঙ্গা মুসলিম পরিবার। উৎসুক জনতার ভিড় দেখে দেখার আগ্রহ হয় এ প্রতিবেদকের। জনতার ভিড়ের ভেতর থেকে দেখা যায় ওই রোহিঙ্গা পরিবারগুলোকে। নারী-পুরুষের এই পরিবারের সামনে রয়েছে চারটি বস্তা। বস্তার ভেতর রয়েছে কিছু খাবার, আর থালা বাসন। গত ২৪ আগস্ট বৃহস্পতিবার রাত ৯টার পরের এ ঘটনা। সেদিন বিকেলে সীমান্ত রেজু আমতলি এলাকা দিয়ে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পথ ভুলে এরা উখিয়া স্টেশনে চলে এসেছে। এভাবে প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গারা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এ দেশে ঢুকে পড়ছেন।
সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর সেনা ও রাখাইন বৌদ্ধদের হাতে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্মম নির্যাতনের ত মুছতে না মুছতে ফের মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত মংডু, বুচিদং ও রাচিডং জেলায় অতিরিক্ত সৈন্য সমাবেশ ঘটাচ্ছে গত সপ্তাহ থেকে। এ ধরনের সৈন্য সমাবেশকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবি টহল জোরদার ও নজরদারি বাড়িয়েছে বলে জানা গেছে।
নতুনভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতনের আশঙ্কায় এসব এলাকা থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমরা আবারো বানের স্রোতের মতো বাংলাদেশে প্রবেশের আশঙ্কা করছেন স্থানীয় লোকজন। গত এক সপ্তাহে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রায় এগারো হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে প্রবেশ করে উখিয়া বালুখালী ও কুতুপালং এবং টেকনাফের লেদা ও মুছনি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে বলে এনজিও সংস্থার রিপোর্টে বলা হলেও সরকারিভাবে এর কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক মনজুরুল হাসান খান সাংবাদিকদের বলেন, কক্সবাজার বিজিবির আওতাধীন সীমান্ত এলাকা দিয়ে কোনো রোহিঙ্গা প্রবেশের তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন রোহিঙ্গা গোপনে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রবেশের চেষ্টা প্রতিহত করা হচ্ছে বলে টেকনাফ বিজিবির অধিনায়ক জানান। কিন্তু ঠিকই রোহিঙ্গা প্রবেশ আগের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে বলে কুতুপালংয়ে বসবাসকারী রোহিঙ্গা সিরাজুল হক ও বালুখালীর নতুন বস্তির মাঝি লালু সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
তাদের মধ্যে টেকনাফ ছাড়াও উখিয়ার কুতুপালং এবং বালুখালীর নতুন বস্তিতে অন্তত পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে আশ্রয় নিয়েছে, যার ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার রাতে উখিয়া স্টেশন জামে মসজিদ সংলগ্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছে কক্সবাজার অথবা অন্য কোনো আত্মীয়স্বজনের বাসায় চলে যাওয়ার জন্য। প্রবেশকারীদের মধ্যে রয়েছে দিল মোহাম্মদ (৪৪), তার স্ত্রী সখিনা খাতুন (৩৫), তাদের চার সন্তান আসাদ (৮), মোহাম্মদ আনাস (৬), হাসান (৪) এবং মোহাম্মদ হোসাইন দেড় বছরের শিশু। তাদের বাড়ি মিয়ানমারের মংডু তামাবিল গ্রামে। এ ছাড়া তাদের রয়েছে একই এলাকার নুরুল আলমের স্ত্রী রাবেয়া খাতুন (৩০)।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের সেনানির্যাতন সইতে না পেরে স্বামীকে ফেলে রেখে এক সন্তান নিয়ে তিনি চলে এসেছেন বাংলাদেশে। এ কই কথা শাহেদা নামে আরেক গৃহবধূর। তার স্বামীও মিয়ানমারে রয়ে গেছে। তারা প্রত্যেকে উখিয়া উপজেলার রাজা পালং ইউনিয়নের রেজু আমতলি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এখন তারা কোথায় যাবেন ভেবে পাচ্ছেন না। এ বিষয়ে রেজু আমতলি বিজিবির সুবেদারের বক্তব্য নেয়ার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করেও মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, গত ৩ আগস্ট মংডুর ময্যু পর্বতমালার পাদদেশে সে দেশের উপজাতির সাত জনের গুলিবিদ্ধ ও ছুরিকাঘাতের লাশ উদ্ধার করা হয়। ইতঃপূর্বে ২৯ সেপ্টেম্বর রাছিদং জেলার একটি নদীতে একই পরিবারের গলাকাটা পিতা পুত্রসহ তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। চলতি বছরের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত রাখাইনের বিভিন্ন এলাকায় ৫৫ জন নিহত ও ৩৪ জন নিখোঁজের তথ্য প্রকাশ করে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলর অং সান সুটির অফিস থেকে। এসব ঘটনার পরিপ্রেেিত আরকান প্রাদেশিক পরিষদের ৯ জন এমপি গত সপ্তাহে মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। ওই বৈঠকের একদিন পর প্রতিকূল আবহাওয়া উপো করে বিমানে করে রেঙ্গুন থেকে আরাকান দেশের রাজধানী সিটুয়ে বিমানবন্দরে অতিরিক্ত প্রায় পাঁচ শতাধিক পদাতিক সৈন্য প্রেরণ করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
বিশেষ করে পূর্বে অবস্থিত কয়েক ডিভিশনের পাশাপাশি রাখাইনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার ঘোষণা দিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনের মংডু, বুছিদং ও রাছিদং জেলায় এসব অতিরিক্ত পদাতিক সৈন্য মোতায়েন করেছে বলে রয়টার্স ও এএফপির খবরে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে নিয়োজিত অতিরিক্ত সৈন্যরা বুছিদং ও রাছিদং জেলার ময্যু পর্বতমালা সংলগ্ন রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে মৌখিকভাবে কারফিউ জারি করেছে। এসব এলাকার লোকজনদের ভুলেও ময্যু পর্বতমালার দিকে অগ্রসর না হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে রোহিঙ্গারা আতঙ্কিত হয়ে নতুনভাবে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছে বলে খবর পাওয়া গেছে।-নয়াদিগন্ত
এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস