সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০১:০২:৩৬

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে নির্দয় বাণিজ্য

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে নির্দয় বাণিজ্য

মিজানুর রহমান, উখিয়া থেকে : রাখাইনের মৃত্যুডেরা থেকে প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে নির্দয় বাণিজ্য শুরু করেছে দালাল চক্র। এই চক্রে আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তারা আবার কেউ কেউ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও প্রশ্রয় পাচ্ছেন।

অসহায়, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছেন এখানে আগে আসা রোহিঙ্গারাও। উখিয়া উপজেলার বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা এবং আরাকান সড়কের দুই পাশে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নিয়েছে নবাগতরা। তবে ওই এলাকার পুরনো কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প এবং নতুন বালুখালি ক্যাম্পকে ঘিরেই রোহিঙ্গাদের জটলা। ক্যাম্প এলাকায় অনেকেই ত্রাণ দিচ্ছেন বলে এখানে রোহিঙ্গাদের ভিড় লেগেই আছে।

সরজমিন এবং প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে রোহিঙ্গাদের নিয়ে নানা বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অবৈধ এ বাণিজ্যের মূল অভিযুক্ত সরকারি দল ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের হলেও তাদের সহযোগী হিসেবে নাম এসেছে বিএনপি, জামায়াত নেতাদের।

স্থানীয় সূত্র এবং ভুক্তভোগীরা অবশ্য সর্বদলীয় এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে বনবিভাগ, পুলিশ ও বিজিবি’র মাঠ পর্যায়ের কয়েকজন সদস্যের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলেছেন। রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী আশ্রম নির্মাণে বন বিভাগ, গরু চোরাচালানে বিজিবির তুমব্রু ফাঁড়ির কয়েকজন সদস্য এবং বালুখালিস্থ হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির কয়েকজন সদস্যের ওপেন সিক্রেট বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড. এ কে এম ইকবালের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি গতকাল বিকালে বলেন, অবৈধ বাণিজ্যের বিষয়ে তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আসেনি। তবে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় দালাল-সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রশাসন স্বউদ্যোগে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়েছে।

তাৎক্ষণিক ওই অভিযানে এ পর্যন্ত ২০০ দালালকে জেল-জরিমানাসহ বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হয়েছে বলে জানান পুলিশ সুপার।

তিনি এও বলেন, নবাগত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় কেন্দ্র নির্র্মাণে বালুখালিতে এরই মধ্যে ১৫০০ একর জমি বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। নির্ধারিত জায়গায় কাঁটা তারের বেড়া দেয়া হবে। এখানে সবাইকে রেজিস্ট্রেশন করে থাকতে হবে। কেউ যদি রেজিস্ট্রেশন না করে তাহলে তারা কোনো যানবাহনে চড়তে পারবে না। নবাগত প্রায় সব রোহিঙ্গাকে একসঙ্গে ওই প্রস্তাবিত ক্যাম্পে রাখতে চাইছে সরকার।

এখন কেউ টাকা পয়সা দিয়ে বন বিভাগ কিংবা সড়ক বিভাগের জায়গায় অবৈধভাবে তাঁবু বা ঘর বানানোর চেষ্টা করছেন তাদের অতিদ্রুত ক্যাম্পে সরিয়ে নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

বন বিভাগের জায়গায় সিন্ডিকেটের রোহিঙ্গা বস্তি: বন বিভাগের জায়গায় বিশেষ করে পাহাড়ের আনাচে-কানাচে রোহিঙ্গা বস্তি নির্মাণের নামে জমিদারি শুরু করেছে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট। সরজমিন এবং স্থানীয়দের সরবরাহ করা তথ্যমতে, চিহ্নিত এসব সিন্ডিকেট বনবিভাগ ও সরকারি খাস জমিতে ঘর বানিয়ে রোহিঙ্গাদের কাছে ভাড়া দিচ্ছে। ঘরপ্রতি অগ্রিম নেয়া হচ্ছে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা।

মাসিক ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা। তবে বড় ঘরের ক্ষেত্রে এটি দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত দর ওঠছে। উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের কুতুপালং, পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালী, হাকিমপাড়া, তেজনিমার খোলা, বাঘঘোনা নামক স্থানে এসব অবৈধ বস্তি নির্মাণ করা হচ্ছে। নির্মাণাধীন এসব বস্তির পেছনে ঘুরে ফিরে মোটাদাগে ৫ জন স্থানীয় নেতার নাম এসেছে।

যদিও এর মধ্যে ৪ জন তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। একজনের মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে। যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে তারা নিজেদের দায় অস্বীকার করলেও রাজনৈতিক বা নির্বাচনী প্রতিপক্ষের ওপর দায় চাপিয়েছেন। সিন্ডিকেটের হোতারা যাদের ওপর দায় চাপিয়েছেন স্থানীয় সূত্রগুলো অবশ্য তাদের সম্পৃক্ততার সত্যতাও নিশ্চিত করেছে।

তবে সূত্রগুলো বলেছে, দলের যে কোনো পর্যায়ের নেতারাও রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নিক না কেন হোতাদেরকে এর ভাগ দিতেই হয়। ৫ নেতা অনেকটা ঘরে বসেই তাদের ‘জমিদারি’ নিয়ন্ত্রণ করেন। ঘরে বসেই গত কয়েক দিনে তারা লাখ লাখ টাকা কামাই করেছেন। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ওই নেতাদের মধ্যে কুতুপালং বস্তির নিয়ন্ত্রণে রাজাপালং ইউপি সদস্য বখতিয়ারের হাতে।

বালুখালী বস্তি নিয়ন্ত্রণ করেন পালংখালী ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের মেম্বার আবছার, হাকিমপাড়া বস্তির নিয়ন্ত্রণ ৫ নং ওয়ার্ড মেম্বার নুরুল আমিনের হাতে। তাজনিমার খোলা বস্তির নিয়ন্ত্রণে ৪ নং ওয়ার্ডের মেম্বার জয়নাল ও বাখঘোনা বস্তির নিয়ন্ত্রণে পালংখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএ মন্‌জুর।

স্থানীয়রা জানিয়েছে, বস্তি নিয়ন্ত্রণে তারা বস্তিপ্রতি ২০/৩০ জন সহযোগী নিয়োগ দিয়েছেন। সহযোগীরা কেবল বস্তি নির্মাণই নয়, সীমান্ত এলাকা রহমতের বিল, আনজিমান পাড়া, হোয়াংক্যৎ লম্বাবিল থেকে গাইড করে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসার কাজও করে। স্থানীয় তাজমিনার খোলায় বনবিভাগের জায়গায় পাহাড়ের পাদদেশে ইতিমধ্যে হাজারও রোহিঙ্গা বস্তি বা আশ্রম নির্মিত হয়েছে। এর নিয়ন্ত্রণকারীর খোঁজ নিতে সিন্ডিকেটের এক সদস্যের সঙ্গে কথা হয় মানবজমিনের স্থানীয় এক প্রতিনিধির। সঙ্গে ওই প্রতিবেদকও ছিলেন।

বস্তিটি দেখভালে স্থানীয় জয়নাল মেম্বারের নিয়োজিত সিন্ডিকেট সদস্য ছৈয়দ হোসেন জানান, তার মাধ্যমে ইতিমধ্যে ওই বস্তিতে নতুন আসা প্রায় ২ হাজার  রোহিঙ্গার আশ্রয় হয়েছে। তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ঘরপ্রতি তারা অগ্রিম নিয়েছেন ৫  থেকে ৮ হাজার টাকা। প্রতিমাসে ভাড়া নেবেন ৮ শ’ টাকা।

ছৈয়দ হোসেনের কাছ থেকে ঘর ভাড়া নেয়া রোহিঙ্গা ছেনুয়ারা বেগম (৪৫) জানান, সীমান্ত পেরিয়ে ৫  ছেলেমেয়ে নিয়ে এসে কোনো কূল- কিনারা না পেয়ে ৫ হাজার টাকা দিয়ে জায়গা কিনে বসবাস আরম্ভ করেছে তারা। ৫ হাজার টাকা  জোগাড় করতে তাকে কানের দুল বিক্রি করতে হয়েছে।

শুধু ছেনুয়ারা নয়, মিয়ানমারের খিয়ারীপাড়া থেকে আনা আবুল হোসেন, বড় গৌজ বিলের হাজেরা, নাইচ্ছাদং এর লায়লা বেগমসহ অনেকের সঙ্গে কথা হয়। সবার বক্তব্য প্রায় অভিন্ন। তারা জানান, টাকা ছাড়া বস্তিতে জায়গা মিলে না। নিজেরা জায়গা করে নিলেও নেতাদের টাকা না দিলে দালালরা রাতে এসে হুমকি ধামকি দেয়। নির্ধারিত সময় দিয়ে বলে যায়। টাকা না দিলে বউ- মেয়েকে তুলে নেয়ার হুমকি দেয়া হয় বলে জানান কয়েকজন রোহিঙ্গা।

অবশ্য সুন্দরী তরুণী এবং নারী যাদের ঘরে রয়েছে বিষয়টি ভিন্ন। তাদেরকে উল্টো দালালরা টাকা পয়সা দিয়ে এবং অতিরিক্ত খোঁজ নেয় বলে জানা গেছে। হাকিমপাড়া বস্তিতে গিয়ে দেখা গেছে, আবুল কাসেম, কামাল, জামাল, রুহুল আমিনসহ ৭ জন বনবিভাগের জায়গায়  রোহিঙ্গাদের জায়গা করে দিতে ব্যস্ত। পরে জানা যায়, তারা মেম্বার নুরুল আমিনের নির্দেশে এ কাজ করছেন।

মিয়ানমারের খেয়ারীপাড়া গ্রাম থেকে আসা আজমল খান ও নুরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তারা জানায়, স্থানীয় আবুল কাসেম ও কামালের কাছ থেকে তারা মাঠের পজিশনগুলো কিনে সেখানে ঘর নির্মাণ করছে। মংডু নাইছংপাড়া থেকে আসা জাফর আলম (৪০) জানান, স্থানীয় রুহুল আমিনের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে তিনি একটি জায়গা নিয়েছেন। ক্যাম্পের বাজার থেকে পলিথিন, বাঁশ ক্রয় করে এখন ঝুপড়ি ঘর নির্মাণ করছেন।

সিন্ডিকেটের হোতারা যা বললেন- রোহিঙ্গাদের নিয়ে নির্দয় বাণিজ্যের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত নুরুল আমিন মেম্বার বলেন, আমি এলাকার মানুষের ভোটে নির্বাচিত। তাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখা আমার দায়িত্ব। আমি সেই দায়িত্বই পালন করছি। আমি রোহিঙ্গাদের নিষেধ করেছি কাউকে টাকা পয়সা না দিতে। এরপরও তারা যদি দেয় তাহলে আমার কিছুই করার নেই। এখন আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে! যারা এটা করেছে আমি তাদের দেখতে চাই। আমার এলাকার কেউ বলে থাকলে আপনাকে সঙ্গে নিয়ে আমি তাদের সঙ্গে কথা বলবো।  

অপর অভিযুক্ত বাখঘোনা বস্তির নিয়ন্ত্রক পালংখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএ মন্‌জুর অবশ্য যুবলীগ নেতা মফিজের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেন। বলেন, মফিজ সব করে আর দোষ আমার ওপর। আমার বিরুদ্ধে যে যা বলেছে তা মিথ্যা, বানোয়াট। আমার এলাকায় আমি কোনো রোহিঙ্গা রাখিনি। তাদের তাড়িয়ে দিয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি।

এদিকে বালুখালী বস্তির নিয়ন্ত্রক বলে অভিযুক্ত পালংখালী ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের সদস্য আবছারও নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন। তিনি বিএনপি-জামায়াতের ঘাড়ে দোষ চাপান। বলেন, আমার এলাকায় যেসব ক্রাইম হচ্ছে তা বিএনপি-জামায়াত মিলে করছে। আর এতে শেল্টার দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা।

তিনি বলেন, আমি সব বলবো। তবে যারা আমার কথা বলেছে এরা মিথ্যা বলেছে। এখানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাণিজ্য করছে বিএনপি নেতা জাফর ইকবাল ও তার ভাই গফুর। তারা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ঘর প্রতি আড়াই থেকে ৫০০০ টাকা নিচ্ছে। আমি বিষয়টি জাফরের বড় ভাই সেলিমকে জানিয়েছি। সেলিম এখনো কোনো ব্যবস্থা নেননি।

বিএনপি নেতা জাফরকে আওয়ামী লীগ নেতা ফজল কাদের সমর্থন দেন জানিয়ে তিনি বলেন, এখানে আমির হোসেন হেডম্যান এবং তার ছোট ভাই কামালের যোগসাজশ রয়েছে। তারা বনবিভাগের সঙ্গে মিলে এ বাণিজ্য করছে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের নেতা হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি আকবর আহমদও রয়েছে বলে জানান স্থানীয় ওই ইউপি মেম্বার। এমজমিন

এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে