রবিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০১:৩৯:৪৯

অর্ধলক্ষ রোহিঙ্গা ১৫ দিন ধরে লতাপাতা খেয়ে বেঁচে আছে!

অর্ধলক্ষ রোহিঙ্গা ১৫ দিন ধরে লতাপাতা খেয়ে বেঁচে আছে!

আবু সালেহ আকন ও গোলাম আজম খান শাহপরীর দ্বীপ (টেকনাফ) থেকে : নাফ নদীর মোহনায় মিয়ানমারের মংডুর নাইক্ষ্যংদিয়ায় অর্ধলক্ষ রোহিঙ্গা আটকে আছে ১৫ দিন ধরে। এ ক’দিন তারা সেখানে লতাপাতা খেয়ে কোনোমতে বেঁচে আছেন। ওই এলাকা থেকে এপারে আসা কয়েকজন রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, তাদের উদ্ধারের আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই। হয়তো ওখানেই আটকে থেকে তাদের প্রাণ যাবে। এ দিকে বর্মি বাহিনী ও নাডালা বাহিনীর সদস্যরা মংডু ও বুচিডং এলাকায় রোহিঙ্গা নির্মূলের পর এখন রাসিডং হয়ে আকিয়াব বন্দরের দিকে এগুচ্ছে বলে সেখানকার একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

স্থল সীমান্তে মাইন পুঁতে রাখায় এখন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসার একমাত্র উপায় নাফ নদী পার হওয়া।এই নদী পার হয়েই এখন হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। শুক্রবার মধ্য রাত থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ওই নদী পার হয়ে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে অন্তত ১০ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে বলে স্থানীয় বাসিন্দা ও স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়েছেন। গতকাল দুপুরের দিকে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায় স্রোতের মতো রোহিঙ্গা প্রবেশ করছে। এমন অনেকে আছেন যারা ১৫-২০ দিন হেঁটে নাফ নদী পার হয়েছেন। ওপারে এখনো বাড়ির পর বাড়ি, পাড়ার পর পাড়া জ্বলছে। নির্যাতনের শিকার হচ্ছে রোহিঙ্গা নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ সবাই। কোনো কোনো গ্রামে এখন কোনো মানুষ নেই। এপারে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এসব কথা জানিয়েছেন। সেনা ও মগদের গুলি ও নির্যাতনে আহতদের অনেকে ১৫-২০ দিন পাহাড় জঙ্গলে থেকে কিছু সুস্থ হয়ে এখন এপারে চলে আসছেন। গতকাল ৭০ জন রোহিঙ্গাকে বর্মি সেনা ও নাডালা বাহিনীর সদস্যরা হত্যা করেছে বলে জানা গেছে।

এ দিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এখনো কাটেনি। গতকাল ত্রাণ নিতে গিয়ে তিনজন নিহত হয়েছেন গাড়ির নিচে চাপা পড়ে। অনেকে ত্রাণ দিতে এসে অনেকটা তামাশা করছেন। একটি কলা দিয়ে মোবাইল ফোনে সেলফি তুলছেন তিনবার। এ দিকে অসহায় এই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে নানাভাবে প্রতারণা করে চলছে অসাধু চক্র। কোনো কোনো এলাকায় নিয়মিত ত্রাণ পৌঁছলেও কোনো কোনো এলাকায় একেবারেই ত্রাণ পৌঁছছে না। যারা দূর-দূরান্ত থেকে ত্রাণ দিতে আসছেন তাদেরকে বিভ্রান্ত করছে পুরনো রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।

মৃত্যুঝুঁকিতে অর্ধলক্ষ রোহিঙ্গা
পালিয়ে এপারে আসা রোহিঙ্গারা বলেছে, তাদেরকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে লুটপাট করে বর্মি সেনা ও নাডালা বাহিনীর সদস্যরা। এরপর শূন্য ঘরে তারা আগুন দেয়। জীবন বাঁচাতে রোহিঙ্গারা যে যেভাবে পারে দৌড়ে পালিয়ে যায়। এর মধ্যে অনেককে ধরে হত্যা করা হয়। মংডুর গড়াখালীর ফিরোজ আহমেদের ছেলে কবির আহমেদ বলেন, যারা প্রাণে বেঁচেছেন তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এপারে চলে আসেন। অনেকেই আছেন যারা অর্থকড়ি কিছুই আনতে পারেন না। যাদের সাথে অর্থকড়ি কিছু থাকে তারা মগদের তা দিয়ে সীমান্ত এলাকায় এসে এপারে চলে আসেন। কিছু মগ অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কারের বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের সহায়তা করে থাকে। যাদের অর্থকড়ি না থাকে তাদের সহায়তার কেউ নেই। এ রকম অন্তত অর্ধলক্ষ রোহিঙ্গা নাইক্ষ্যংদিয়া দ্বীপে আটকে আছেন।

কবির আহমেদ বলেন, তারা নিজের চোখে দেখে এসেছেন ওইসব রোহিঙ্গা লতা-পাতা খেয়ে গত ১৫ দিন পার করেছেন। রাসিডংয়ের নুর আহম্মেদ বলেন, ওই এলাকায় হাজার হাজার মানুষ আটকে আছেন। তারা এপারে আসতে পারছেন না। কেউ তাদেরকে সাহায্য করছেন না। ইসলামী ঐক্যজোটের যুগ্ম মহাসচিব গাজী ইয়াকুব গতকাল বলেন, তারা সপ্তাহখানেক ধরে শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় কাজ করছেন রোহিঙ্গাদের সহায়তায়। তারা জানতে পেরেছেন নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকায় ২৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা আটকে আছেন। তারা লতাপাতা খেয়ে জীবন টিকিয়ে রেখেছেন। তাদেরকে কিভাবে উদ্ধার করবেন তার পথ খুঁজে পাচ্ছেন না তারা।

বুচিডংয়ের নয়াপাড়ায় ৭০ জন নিহত
গতকাল শনিবার বুচিডংয়ের পাহাড়ি এলাকা মিংগিরি নয়াপাড়া এলাকায় ৭০ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। নিহত এই রোহিঙ্গাদের আত্মীয়স্বজনদের অনেকেই আগে বাংলাদেশে এসে পৌঁছান। তাদের সাথে নিয়মিত এপারের শরণার্থীদের কথা হতো। গতকাল দুপুরের পর থেকে তাদের সবার মোবাইল ফোন বন্ধ। পরে তারা জানতে পারেন, পাহাড়ি এলাকা থেকে পালিয়ে আসার সময় ওই রোহিঙ্গারা বর্মি সেনা ও নাডালা বাহিনীর সামনে পড়েন। এরপর তাদের একটি পরিত্যক্ত বাড়ির মধ্যে আটকে সবাইকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এ খবর শোনার পরে এপারে থাকা তাদের আত্মীয়স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। সাবরাং এলাকায় ওই সব রোহিঙ্গা শরণার্থীকে কান্নাকাটি করতে দেখা যায়।

বর্মি বাহিনী যাচ্ছে আকিয়াবের দিকে
মংডু, বুচিডং ও রাসিডংএ বর্মি সেনা ও নাডালা বাহিনী তাদের অপারেশন প্রায় শেষ করেছে। এখানে মুসলমানদের আর কোনো গ্রাম অবশিষ্ট নেই। সব মুসলিম গ্রাম ও পাড়া এখন জনমানবশূন্য। এই অভিযান শেষের পর তারা এখন আকিয়াবের দিকে এগুচ্ছে বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে। সেখানকার একাধিক বাসিন্দা বলেছেন, বর্মি সেনা ও নাডালা বাহিনীর সদস্যরা প্রতিদিন বেলা ১০টার দিকে তাদের অভিযান শুরু করে। সন্ধ্যার আগেই তারা অভিযান শেষ করে। এভাবে গত ২৪ আগস্ট থেকে তারা মংডু, বুচিডং ও রাসিডং এলাকায় তাদের অভিযান চালিয়ে সেসব এলাকা রোহিঙ্গাশূন্য করে ফেলেছে। এখন তারা আকিয়াবের দিকে যাচ্ছে। আকিয়াবে যেসব মুসলমান রয়েছে তাদের অধিকাংশই ধনী। এটা একটা সমুদ্রবন্দর। একসময় আরাকান রাজ্যের রাজধানী ছিল এই আকিয়াব। সূত্র জানায়, এখানে অভিযান শুরু হলে একমাত্র সমুদ্রপথে পালিয়ে আসা ছাড়া সেখানের রোহিঙ্গাদের আর কোনো পথ থাকবে না। ২০১২ সালে আকিয়াবে জাতিগত দাঙ্গার সময়ও এই পথে মুসলমানরা সেখান থেকে পালিয়ে আসেন।

ত্রাণ বিতরণে চরম বিশৃঙ্খলা
এ দিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাঝে ত্রাণ বিতরণে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। ত্রাণ নিতে গিয়ে গতকাল কুতুপালং এলাকায় তিন শরণার্থী নিহত হয়েছেন। গাড়ি চাপায় তারা নিহত হন বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কিছু মানুষ চলন্ত গাড়িতে বসে ত্রাণ শরণার্থীদের মাঝে উড়িয়ে দেন। এ সময় শরণার্থীরা দলবদ্ধভাবে ওই সব গাড়ির সামনে-পেছনে দৌড়াতে থাকে। গতকাল এমনই একটি গাড়ির নিচে পড়ে নিহত হয়েছেন তিন শরণার্থী।

অনেক এলাকায় ত্রাণ যাচ্ছে না
অনেক শরণার্থী ত্রাণ পাচ্ছেন না। এমনও এলাকা আছে যেখানে গাড়ি প্রবেশ করে না। ওইসব এলাকায় হাজার হাজার শরণার্থী থাকলেও তাদের কাছে ত্রাণ যায় না। যারা ত্রাণ নিয়ে আসছেন তারা সহজে রাস্তার পাশে থাকা শরণার্থীদের ত্রাণ দিয়ে চলে যাচ্ছেন। যারা এক কিলোমিটার দূরে ভেতরে রয়েছেন সেসব শরণার্থী ত্রাণ পাচ্ছেন না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এমন এলাকার মধ্যে টেকনাফের হ্নিলা, লম্বাবিল, হোয়াইকং, কাঞ্জর পাড়া, নয়াপাড়া বটতলী, খারাংখালী, মৌলভীবাজার, নাইক্ষণছড়ির তুমব্রু, চাকঢালা, জারাইলছড়ি ও নাফ নদীর মোহনাস্থলে ত্রাণ নিয়ে কেউ যাচ্ছেন না। ফলে সেখানকার শরণার্থীরা চরম সঙ্কটে রয়েছেন।

শাহপরীর দ্বীপ হয়ে ১২ ঘণ্টায় ঢুকেছেন ১০ হাজার
স্থলপথে মাইন পুঁতে রাখায় রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এখন সমুদ্র ও নদীপথ বেছে নিয়েছেন। অধিকাংশ রোহিঙ্গা এখন নাফ নদী পার হয়ে সাবরাংয়ের জালিয়া পাড়া এবং শাহপরীর দ্বীপ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন। শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় স্বেচ্ছাসেবীদের ১১টি টিম কাজ করছে। এর একটি টিমের প্রধান গাজী ইয়াকুব বলেছেন, শুক্রবার মধ্যরাত থেকে তারা কাজ শুরু করেছেন। ওই সময় থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত কমপক্ষে ১০ হাজার রোহিঙ্গা এই রুট দিয়ে প্রবেশ করেছেন। তিনি বলেন, সন্ধ্যার পরে রোহিঙ্গারা নাফ নদী পার হয়ে এপারে আসেন। এরপর তারা কিছু সময় শাহপরীর দ্বীপে বিশ্রাম নেন। দীর্ঘ পথ হেঁটে আসার ফলে তাদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। মধ্যরাত থেকে তারা শাহপরীর দ্বীপ থেকে সাবরাং হয়ে টেকনাফে প্রবেশ শুরু করেন। ওই স্বেচ্ছাসেবীরা শাহপরী হয়ে এসব রোহিঙ্গাকে সাবরাং পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেন।

এখনো পুড়ছে বাড়িঘর
গতকাল টেকনাফ জেটি ও শাহপরীর দ্বীপ জেটি থেকে দেখা যায় মংডুর বিভিন্ন এলাকায় আগুন জ্বলছে। গত শুক্রবার জুমার আগে মংডু প্রধান শহরের (টাউনশিপ) মুসলিম আবাসিক এলাকায় আগুন লাগিয়ে দেয় বর্মি সেনা ও নাডালা বাহিনী। গতকাল দুপুরেও ওই এলাকা থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখা যায়। ধোঁয়ায় পুরো এলাকার আকাশ আচ্ছন্ন হয়ে আছে। যে ধোঁয়া মংডু পাহাড়ের বেশ কিছু অংশ ঢেকে রেখেছে।-নয়াদিগন্ত
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে