বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১১:৫২:৫৩

রাখাইনের পর মংডু শহরের রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীদেরও হত্যা করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী

রাখাইনের পর মংডু শহরের রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীদেরও হত্যা করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী

নিউজ ডেস্ক: মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতা থামছেই না। এতোদিন তারা রাখাইনের রোহিঙ্গাদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। নির্বিচারে হত্যা করেছে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুদের। এবার তারা সেখানের মংডু শহরের রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীদের হত্যা করছে বলে সেখান থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন।

সীমান্ত পেরিয়ে আসা লোকজনের কাছ থেকে জানা গেছে, এখনো ওপারে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করার সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। তারা ছোট ছোট গ্রুপে রাতের বেলা নাফ নদী পার হয়ে অথবা সমুদ্র পথে ছোট ছোট মাছ ধরার নৌকায় এপারে আসছেন। মংডু শহর থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, এতোদিন গ্রামের দিকে তাণ্ডব চালালেও মংডু শহরের রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীদের গায়ে কোনো আঁচ লাগেনি। কিন্তু এবার মংডুর ব্যবসায়ীদের হত্যা-নির্যাতন শুরু হয়েছে। অর্থকড়ি, স্বর্ণালঙ্কার লুট করার পর তাদেরও গুম করে ফেলা হচ্ছে।

এ দিকে রাখাইনের বুচিডং, রাচিডংয়ের শহরের বাইরের রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা-নির্যাতন এখনো বন্ধ হয়নি। বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে কৌশল করে। এমনভাবে বাড়িঘরগুলো পুড়িয়ে দিচ্ছে যেন বাইরে থেকে মিডিয়ার নজরে কম পড়ে। মিয়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্তের কাছের অবশিষ্ট বাড়িঘরগুলো বিকেলের দিকে পোড়াচ্ছে যখন সীমান্তে অবস্থান করা বাংলাদেশ কিংবা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সাংবাদিকেরা স্পট থেকে সরে যান। গতকাল বুধবার ও আগের দিন মঙ্গলবার যারা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন তাদের সাথে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

গতকাল বুধবার কথা হচ্ছিল মংডু শহরের বাসিন্দা লোকমান হাকিমের সাথে। তিনি গত মঙ্গলবার শাহপরীর দ্বীপে এসেছেন এবং গতকাল বুধবার উখিয়ার পালংখালীর গয়ালমারা এলাকায় এসেছিলেন পরিবারের লোকজনের জন্য নিরাপদ জায়গা খুঁজতে। তাকে রাখাইন রাজ্যের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান, গত ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া নির্যাতন গ্রামের দিকে চললেও মংডু শহর মোটামোটি নিরাপদ ছিল। কিন্তু এখন সেনাবাহিনীর বর্বরতা এখানেও শুরু হয়েছে। মংডু শহরের বাইরের অবশিষ্ট ঘরগুলোও পোড়াচ্ছে মগ বাহিনী (মিয়ানমার সেনাবাহিনী)।

লোকমান হাকিম জানান, মংডুর রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীরাও এখন আর নিরাপদ নন। এখনো যারা টিকে আছেন তারা বাংলাদেশে চলে আসার চিন্তা করছেন। মংডুর রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীদের সেনারা ডেকে নিয়ে যাচ্ছে ওদের ক্যাম্পে। সেখান থেকে অনেক কিয়াট (মিয়ারমারের মুদ্রা) তাদের উৎকোচ দিয়ে ছাড়া পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। পরদিন অথবা তার পরের দিন সেনাদের আরেকটি দল তাদের ডেকে নিয়ে যাচ্ছে। এই গ্রুপটি রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীদের অবশিষ্ট টাকা, স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে নিচ্ছে মুক্তি দেয়ার বিনিময়ে। এবং শেষবার আরেক দল সেনা ব্যবসায়ীদের ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের আর খোঁজ মিলে না।
লোকমান হাকিম জানান, ধরে নিয়ে যাওয়ার পর এদের মেরে ফেলা হয়। এ কারণে এবার মংডু শহরের অবশিষ্ট রোহিঙ্গা ব্যবসায়ী অথবা টাকা-পয়সা আছে এমন লোকেরা বাংলাদেশে চলে আসার চিন্তা করছেন। কেউ কেউ ইতোমধ্যেই পালিয়ে পাহাড়ে-জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছেন। এরা যেকোনো সময় বাংলাদেশে আসবেন।

রাখাইনের যেসব এলাকা সেনারা ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাশূন্য করে ফেলেছে তাদের বাড়িঘরও পোড়ানো শুরু হয়েছে। রাচিডংয়ের ৮-১০ বছরের শিশু মনির আহমদ। সে কথা বলছিল আর তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। সে বলছিল তার বাবা জকরিয়াকে গলা কেটে হত্যা করেছে সেনারা। এটা দেখে দুই ভাই ও দুই বোনকে নিয়ে মায়ের সাথে চলে এসেছি বাড়িঘর ছেড়ে। মনিরের বাবা কৃষিকাজ করতেন। তার মায়ের নাম ওমস খাতুন।

একই এলাকার মো: আসাদের স্ত্রী গুলতাজ বেগম জানান, তার মেয়ের জামাই ফজল আহমদ ও ছেলে আতাউল্লাকে ধরে নিয়ে গেছে মগেরা। এরপর তাদের আর পাওয়া যায়নি। মগেরা তাদের বাড়িঘরও জ্বালিয়ে দিয়েছে।

রাচিডংয়ের রেহানার স্বামী আব্দুস সালামকে গলা কেটে হত্যা করেছে মগেরা। তার ১৮ বছরের মেয়ে ফাতেমাকে মগেরা বাথরুমে আটকে জুলুম করতে গেলে তার বড় দুই ছেলে এটা সহ্য করতে না পেরে বোনকে ছাড়াতে যায়। কিন্তু মগেরা তার দুই ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর মেয়েটার ওপর একের পর এক জুলুম করে হত্যা করে। রেহানা এ প্রতিবেদকের কাছে এসব বলছিলেন আর তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল।

তিনি জানান, তার স্বামী আব্দুস সালামেরও কোনো খবর নেই। তিনি বেঁচে আছেন কিনা তা রেহানা জানেন না। তিন দিন আগে রেহানা নাফ নদীর তীরে কুইন্যা পাড়ায় এসে লুকিয়ে ছিলেন। পরে সুযোগ বুঝে গতকাল সকালে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে উখিয়ার দিকে এসেছেন।

রাখাইনের মংগনামার শিলবুনিয়ার সালেহ আহমেদের একমাত্র ছেলে মো: জহরকে সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। তিনি জানান, তারা গত ৯ আগস্ট ১৪ জনের সাথে তার ছেলে মো: জহরকেও গুলি করে হত্যা করা হয়।

মংডুর বাসিন্দা লোকমান হাকিমকে আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি) সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান, আরসার কোনো অস্তিস্ত আছে বলে তিনি মনে করেন না। আমরা আরসার কাউকে চিনি না। একটু লেখাপড়া জানা লোকমান হাকিম বললেন, মংডু শহরে আমরা জাতিসঙ্ঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট সম্বন্ধে শুনেছি। আরসার আক্রমণ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হলে লোকমান হাকিম বলেন, আরসা যদি রোহিঙ্গাদের বন্ধু হবে তাহলে কফি আনানের রিপোর্ট দেয়ার পর দিনই আরসা কেন মগ বাহিনীর ওপর আক্রমণ করবে?

তিনি বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এক বছর আগে থেকেই রোহিঙ্গাদের বাড়ি থেকে দা, ছোরার মতো ধারালো সব কিছুই নিয়ে গেল। সেদিন থেকে কারো কাছে ধারালো কিছু পেলে তাকে ধরে শাস্তি দিতে শুরু করল। আবার আনান কমিশনের রিপোর্ট দেয়ার অনেক দিন আগে থেকেই শুনেছি সেনাবাহিনীর সদস্যদের রাখাইন রাজ্যে মোতায়েন করে রেখেছে। আর আরসা যদি রোহিঙ্গাদের বন্ধুই হবে তাহলে কেন রোহিঙ্গাদের এই বিপদের দিনে তারা এগিয়ে আসে না। আমরা তো সব হারিয়ে ফেলেছি। এই বিপদের মধ্যে আমরা কেন আরসার সাহায্য পেলাম না।

লোকমান শেষে বললেন, রোহিঙ্গাদের হত্যা করার জন্য এটা মগ বাহিনীর কৌশল। এরা আমাদের হত্যা-জুলুম নির্যাতন করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। এরা আমাদের বাঙালি বলে; কিন্তু আমরা মিয়ানমারে কয়েক শ’ বছর ধরে বাস করছি।
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে