আবু সালেহ আকন, নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত: অভিযান শুরুর অন্তত ১০ দিন আগে রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে তল্লাশি করে দা-বঁটি, ছুরি-চাকুও নিয়ে যায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। রোহিঙ্গারা যাতে ন্যূনতম প্রতিবাদ গড়ে তুলতে না পারেন সে জন্যই বর্মি সেনারা দা-বঁটিগুলো নিয়ে যায়। এমনকি তরিতরকারি কাটার জন্য ছুরি-চাকুও রেখে যায়নি সেনারা। মুসলমানদের ওপর এই হত্যা-নির্যাতন পূর্বপরিকল্পিত। পুলিশ ও সেনাক্যাম্পে হামলার ঘটনাও ওই প্রক্রিয়ারই অংশ।
গত ২৪ আগস্ট থেকে মিয়ানামার সেনাবাহিনী রাখাইনের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর ব্যাপক নির্যাতন শুরু করে। সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের পাড়ায় ও বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালায়। একই সঙ্গে আকাশ পথ ও স্থলপথে হামলা চালানো হয় অসহায় মুসলমানদের ওপর। প্রত্যক্ষদর্শী রোহিঙ্গা মুসলমানেরা বলেছেন, উগ্র বৌদ্ধরা গলা কেটে আর সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। অনেক এলাকায় পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয় রোহিঙ্গাদের। কোথাও কোথাও রোহিঙ্গাদের হত্যা করে পুকুরে লাশ ফেলে তার ওপর ড্রেজার দিয়ে মাটিচাপা দেয়া হয়। সেই অত্যাচার-নির্যাতন এখনো অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ সীমানায় দাঁড়ালে এখনো দেখা যায় ওপারে মুসলমানদের ঘরবাড়িতে আগুন জ্বলছে।
আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলেছেন, আরাকান (বর্তমানে রাখাইন) রাজ্য থেকে মুসলমানদের পুরোপুরি উৎখাতের জন্যই এই আক্রমণ। এটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। যে কারণে ছুরি-কাঁচি পর্যন্ত তারা জব্দ করে নিয়ে যায়। রোহিঙ্গা মুসলিম হাফেজ সৈয়দ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলে এই অভিযান চালানো হয়েছে ওই অভিযোগটি পুরোপুরি মিথ্যে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী অভিযোগ করেছে তাদের ৩০টি পুলিশ ক্যাম্প ও একটি সেনাক্যাম্পে হামলা চালানো হয়েছে। হাফেজ সৈয়দ হোসেন বলেন, এই মিথ্যা অভিযোগ দিয়েই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। অথচ তারও ১০ দিন আগে রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে ছুরি-কাঁচি পর্যন্ত নিয়ে যায় বর্মি সেনারা।
সৈয়দ হোসেন বলেন, তাদের ঘর থেকে মাছ ও তরিতরকারি কাটার দা-বঁটিও নিয়ে গেছে। ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে ওগুলো নিয়ে যাওয়ার পরই অভিযান শুরু করে সেনারা। রোহিঙ্গা মুসলমানরা যাতে ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারেন সে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরেই সেনাবাহিনী তাদের ওপর হামলে পড়ে বলে তিনি জানান।
মংডুর তৈজ্যংপাড়ার শহিদুল আমিন বলেছেন, ১৩ আগস্ট তাদের পাড়ায় তল্লাশি করে প্রতিটি ঘর থেকে ধারালো চাকু, ছুরি, দা-বঁটি নিয়ে যায় সেনারা। তখন তাদেরকে বলা হয়েছিল কোরবানির পর ওগুলো আবার ফেরত দেয়া হবে। শহিদুল আমিন বলেন, তারা বুঝতেও পারেননি এরই মধ্যে এভাবে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালাবে বর্মি সেনারা।
মংডুর পোড়া মাইজ্যার আবু তাহের বলেন, তাদের কোনো বাড়িতে মাছ কাটার বঁটিও রেখে যায়নি। এরই মধ্যে তাদের ওপর আক্রমণ শুরু হয়। তিনি বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর যে আক্রমণ চালাবে সেটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। আর সেনাচৌকি ও পুলিশক্যাম্পে হামলার বিষয়টি ছিল তাদের সাজানো নাটক। ওই অজুহাতে যাতে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা চালানো যায় সেই প্লাটফর্ম তৈরির জন্যই পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালানো হয়। আবু তাহের বলেন, তাদের জানামতে ওই হামলার সঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলমানদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।
পালিংগাজিরির বাসিন্দা আফসার নামে অপর এক রোহিঙ্গা বলেন, মুসলমানরা তো পাড়ার বাইরেই যেতে পারেন না। শহরে যেতে হলে তাদের অনুমতি লাগে। তাহলে কিভাবে তারা সেনাচৌকি ও পুলিশ ক্যাম্পে হামলা চালাল? বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া অনেক রোহিঙ্গা মুসলমানের সাথেও কথা হয়। প্রত্যেকেই বলেছেন, সেনাচৌকি ও পুলিশ ক্যাম্পে হামলার সাথে মুসলমানরা সম্পৃক্ত নন। ওই বিষয়টি সাজানো বলে মনে করেন রোহিঙ্গারা। তারা বলেন, ওটি ছিল অজুহাত মাত্র। যাতে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালানো যায়, তাদের হত্যা ও নির্যাতন করে দেশ থেকে বিতাড়িত করা যায় সে জন্যই ওই হামলার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়।
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস