নিউজ ডেস্ক: শেষবারের মতো মাইকিং করে রোহিঙ্গাদের মংডু ছাড়ার নির্দেশ দিচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এরপরই ছোট ছোট গ্রামে আগুন দিচ্ছে তারা। মঙ্গলবার মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকা থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা এই তথ্য জানান।
এসব বাসিন্দার অভিযোগ, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা স্থানীয় মগদের দিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে মাইকিং করাচ্ছে। পাশাপাশি আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য কিছু প্রভাবশালী রোহিঙ্গার ঘরে আগুন দেয়।
জানা যায়, রাখাইন রাজ্যের বুচিদং ও রাচিদংয়ের গ্রামের পর গ্রামে হামলা চালিয়ে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পোড়ানোর পাশাপাশি হত্যা, নির্যাতন, অত্যাচার-নির্যাতনে রোহিঙ্গারা নিরুপায় হয়ে পড়ে। অনেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে, অনেকে আবার মংডু শহরের আশপাশের গ্রামগুলোতে আশ্রয় নেয়। কারণ, তখনো এই শহরের আশপাশে তেমন নির্যাতন শুরু হয়নি। কিন্তু ২৬ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে মাইকিং করে রোহিঙ্গাদের এসব এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিচ্ছেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
মংডুর কাদিরবিলের রিকশাচালক নুরুনবী (৫৫) বলেন, ‘মঙ্গলবার মাইকিং করে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলে। এরপর সেনা ও কিছু রাখাইন যুবকসহ গ্রামে এসে কোনো কথা ছাড়াই আমাদের ঘরবাড়িতে আগুন দিয়েছে। ওই সময় প্রাণে বাঁচতে ধানখেতে গিয়ে লুকিয়ে ছিলাম। পরে পরিবারের সাতজন সদস্য নিয়ে হেঁটে নাফ নদীর তীরে আসতে রাত একটা বাজে। এরপর আজ বৃহস্পতিবার ভোররাত চারটার দিকে একটি নৌকায় করে জনপ্রতি পাঁচ হাজার করে টাকা দিয়ে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে ঢুকি।
তাঁর দাবি, ‘অং সান সু চির ভাষণের আগ পর্যন্ত মংডু শহরে আমাদের বাড়িঘর আগে পোড়ায়নি এবং ওই এলাকার রোহিঙ্গাদের কিছু ত্রাণ হিসেবে চাল, ডাল দেওয়া হলেও সেগুলো সেনা সদস্যরা পরে কেড়ে নিয়েছেন।
মংডুর ম্যারুল্লা পাড়া এলাকার মো. শফি বলেন, ‘বাড়ি থেকে হেঁটে নাফ নদীর তীরে আসতে আমাদের একদিন লেগেছে। কোনও টাকা পয়সা ছিল না। আল্লাহর ওয়াস্তে মাছ ধরার নৌকায় পার করে দিয়েছে। আমাদের বাড়ি আগে পোড়ায়নি। সোমবার মগরা মাইকিং করে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলে। এরপর সেনাবাহিনী আমাদের ঘর-বাড়িতে আগুন দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘স্ত্রী বেগম বাহার, ছয় মেয়ে ও তিন ছেলেসহ মোট ১১ জনকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছি। আমাদের কোনও আত্মীয়-স্বজন নেই বাংলাদেশে। সরকার যদি জায়গা দেয় থাকবো।’
মংডুর আশিকাপাড়া থেকে পালিয়ে এসে টেকনাফের হারিয়াখালী গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন ছৈয়দা বেগম। তিনি বলেন, ‘মংডু শহরের পাশেই আমাদের বাড়ি। ঘটনার শুরুর পর থেকে কয়েক হাজার সেনা অবস্থান নিয়েছে শহরে। রোহিঙ্গা মুসলিমরা হাটবাজারে যেতে পারছে না। বেশি প্রয়োজনে গেলেও মারধর করে আহত করছে। ঘরে মজুত থাকা খাবার শেষ হয়ে পড়েছে। তার মধ্যে মাইকিং করে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলেছে। আমরা কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ঘরের পেছনে আশ্রয় নিই। কিন্তু সেনাসদস্যরা বৃষ্টির মতো গুলি করতে থাকে।’
ফয়েজিপাড়ার গৃহবধূ আমেনা খাতুন বলেন, ‘গত ২৭ আগস্ট দিনদুপুরে গ্রামের “থাব্বে” ফরিদ আলম আমার স্বামী নুরুল আমিনসহ ১৭ জনকে ডেকে নিয়ে যায় সেনাবাহিনীর কাছে। ওই সময় পাঁচজনের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা করে আদায় করার পর তাদের ছেড়ে দিলেও আমার স্বামীসহ ১২ জনকে হত্যা করেছে সেনাবাহিনী। কিন্তু স্বামীর লাশ দেখার সেই সুযোগ পাইনি। চার মেয়ে ও তিন ছেলেসহ মোট আটজনকে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছি।’
তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গারা ঘরবাড়ি ছেড়ে বের হওয়ার পরপর মগেরা লুটপাট শুরু করে।
টেকনাফের সাবরাং হারিয়াখালী এলাকায় মংডুর সিকদারপাড়ার বাসিন্দা আবু তৈয়ুব (৪০) বলেন, সেনাবাহিনী, পুলিশ, লুণ্ঠন এবং নাডালা বাহিনী (রাখাইন সম্প্রদায়ের উগ্রপন্থী তরুণ) রোহিঙ্গাদের গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছে। রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে পাহাড়ে-জঙ্গলে আশ্রয় নিচ্ছে। তারা সেখানে খাদ্যসংকটে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।
মংডুর নাপিতের ডেইলের বাসিন্দা আলী হোসেন (৩৮) বলেন, ‘আমাদের সবাইকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বলে। এ জন্য আমরা চলে এসেছি। মাইকিং করে সবাইকে বাড়ি ছাড়তে বলছে। এরপর আগুন ধরিয়ে দেয় সেনাসদস্যরা।’ তিনি বলেন, এলাকায় দিনমজুর কাজ করতেন। নাফ নদী পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকার চালকের হাতে স্ত্রীর এক জোড়া কানের দুল তুলে দিয়েছেন। সেনাবাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গাদের বলেন, তোওয়া, তোওয়া। এর অর্থ হচ্ছে যা যা।
প্রথম দিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রাচিদং ও বুচিদংয়ে রোহিঙ্গাদের প্রায় দেড় শতাধিক গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই সময় উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ি ও টেকনাফের কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে ছিল। তখন প্রায় সাড়ে চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। হঠাৎ করে গত মঙ্গলবার মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আবারও রোহিঙ্গার ঢল নেমেছে। প্রতিদিন টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের বিভিন্ন পয়েন্টে দিয়ে তিন থেকে চার হাজারের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে বলে নিশ্চিত করেছেন সাবরাং ইউপির চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নুর হোসেন।
এদিকে রোহিঙ্গাদের পার করায় গত রবিবার অন্তত ৬ থেকে ৭টি মাছধরা ট্রলারে আগুন দিয়েছে কোস্টগার্ড। কিন্তু তারপরও রোহিঙ্গা পার করা কমেনি। প্রতিদিন রাতেই রোহিঙ্গা প্রবেশ করছে। এমনকি দিনের বেলাতেও নাফ নদী পার হয়ে শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।
নাফ নদীর তীর ধরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা হেঁটে হেঁটে পাহারা দিলেও রোহিঙ্গা প্রবেশে তারা বাধা দিচ্ছে না। শাহপরীর দ্বীপের জেটির অদূরেই জেলেপাড়ায় ছোটছোট মাছধরা নৌকা থেকে রোহিঙ্গাদের নামতে দেখা যায়।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ আগস্ট দিনগত রাতে রাখাইনে যখন পুলিশ ক্যাম্প ও একটি সেনা আবাসে বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এর জেরে ‘অভিযানের’ নামে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। ফলে লাখ লাখ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য চলে আসছেন। সহিংসতার শিকার হয়ে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় সোয়া চার লাখ। তবে বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে। সহিংসতায় প্রাণ গেছে তিন হাজারের বেশি মানুষের। বেসরকারিভাবে এই সংখ্যা দশ হাজার পার করেছে মধ্য সেপ্টেম্বরেই।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনা ও নিন্দার মুখে পড়লেও এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি মিয়ানমার সরকার।
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস