শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০৮:৪৪:৩৮

রোহিঙ্গাদের রক্ষায় ব্যর্থ জাতিসংঘ!

রোহিঙ্গাদের রক্ষায় ব্যর্থ জাতিসংঘ!

নিউজ ডেস্ক: মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে আলোচনা আটকাতে চেয়েছিলেন দেশটিতে নিযুক্ত জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তা। জাতিসংঘ ও সাহায্য সংস্থাগুলোর ভেতরের সূত্র বিবিসিকে এ তথ্য জানিয়েছে। জাতিসংঘের এক সাবেক কর্মকর্তা জানান, এমনকি মানবাধিকারকর্মীদেরও স্পর্শকাতর রোহিঙ্গা এলাকাগুলো পরিদর্শন থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছিলেন জাতিসংঘের মিয়ানমারপ্রধান।

সামরিক বাহিনীর এক অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাণ বাঁচাতে নিজ বাসভূমি থেকে পালিয়ে গিয়েছে পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এরা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে।

এদিকে বিবিসি উদ্ঘাটিত তথ্যগুলোকে অস্বীকার করেছে জাতিসংঘের মিয়ানমার দপ্তর।

বাংলাদেশে গত মাসে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ঢল নামতে শুরু করার পর থেকেই পরিস্থিতি মোকাবেলায় একেবারে সামনের সারিতে এসে দাঁড়ায় জাতিসংঘ। আগত রোহিঙ্গাদের নানা সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি জোর ভাষায় বর্মি (মিয়ানমার) কর্তৃপক্ষের নিন্দাজ্ঞাপন করে এসেছে জাতিসংঘ। কিন্তু মিয়ানমার ও বহির্বিশ্বে কর্মরত জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সহযোগিতা সংস্থার মধ্যকার সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান সংকট শুরু হওয়ার চার বছর আগে মিয়ানমারে জাতিসংঘের কান্ট্রি টিম (ইউএনসিটি) প্রধান রেনাটা লোক-ডেসালিয়েন রোহিঙ্গাদের এলাকায় মানবাধিকারকর্মীদের যাতায়াত বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। একই সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে জনমত তৈরি কার্যক্রম বন্ধেরও চেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, রোহিঙ্গাদের ওপর সম্ভাব্য জাতিগত নিধনের বিষয়ে নিজ সংস্থার যেসব কর্মী কোনো ধরনের হুঁশিয়ারি দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছিল, তাদেরও একঘরে করে রেখেছিলেন তিনি।
চলমান নৃশংসতার আশঙ্কা আগেই দেখতে পেয়েছিলেন জাতিসংঘের এক সাহায্যকর্মী ক্যারোলিন ভান্ডেনাবিলি। ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালের শুরুর দিকে রুয়ান্ডায় ঘটে যাওয়া গণহত্যার সময়ে সেখানে কাজ করেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে মিয়ানমারে এসেই দুই জায়গার প্রেক্ষাপটে আশঙ্কাজনক মিল লক্ষ করেন তিনি।

জাতিসংঘ ও সাহায্য সংস্থাগুলোর জন্য মিয়ানমারের তত্কালীন পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে উঠেছিল। সে সময় রোহিঙ্গাদের কাছে মৌলিক সাহায্য পৌঁছানোর জন্য মিয়ানমার সরকার ও স্থানীয় বৌদ্ধ জনগণের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করার প্রয়োজন দেখা দেয়। আবার সংস্থাগুলো এও জানত, রোহিঙ্গাদের অধিকার ও রাষ্ট্রবিযুক্তির বিষয়ে কোনো কথা বললে, তাতে অনেক বৌদ্ধই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে।

এ কারণে সিদ্ধান্ত ছিল, এ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল বাস্তবায়নের দিকেই দৃষ্টিপাত করা হবে। এজন্য রাখাইন অঞ্চলের উন্নয়নের দিকেই বেশি জোর দেয় জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহল। তাদের প্রত্যাশা ছিল, অঞ্চলটির সমৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধদের মধ্যকার উত্তেজনাও প্রশমিত হয়ে আসবে।

সে সময় জাতিসংঘের কর্মীদের জন্য রোহিঙ্গাদের বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য দেয়ার বিষয়টি রীতিমতো ‘ট্যাবু’ হয়ে দাঁড়ায়। রাখাইন অঞ্চল নিয়ে সে সময় প্রকাশিত জাতিসংঘের অনেক বিবৃতিতেই ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয়। বর্মি সরকারও রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ বা এদের ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী হিসেবে কোনো স্বীকৃতি দিতে বরাবরই অস্বীকৃতি জানিয়ে এসেছে। এদের বরাবরই ‘বাঙালি’ বলে অভিহিত করে এসেছে মিয়ানমার।

মিয়ানমারের প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করার সময়ও আমি দেখেছি, জাতিসংঘের কর্মীদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই রোহিঙ্গাদের নিয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য দিয়েছেন। অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে পরিচালিত এক তদন্তেও এখন উঠে এসেছে, মিয়ানমারে জাতিসংঘের রুদ্ধদ্বার বৈঠকগুলোতেও রোহিঙ্গাদের সমস্যাগুলোকে একপাশে ঠেলে রাখা হতো।

মিয়ানমারের সাহায্য সংস্থাগুলোর বেশকিছু সূত্র জানিয়েছে, সেখানে জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকগুলোয় বর্মি কর্তৃপক্ষকে রোহিঙ্গাদের অধিকারের প্রতি সম্মান জানানোর দাবি উত্থাপন করে বক্তব্য দেয়াও রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
ভান্ডেনাবিলি বলেন, শিগগিরই সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে রোহিঙ্গাদের সমস্যা বা জাতিগত নিধন বিষয়ে সতর্কবাণীর কোনো গ্রহণযোগ্যতাই নেই।

তিনি বলেন, ‘এটা করা যেত ঠিকই, কিন্তু তার পরিণামও ভুগতে হতো এবং এসব পরিণাম ছিল বেশ নেতিবাচক। যেমন এরপর থেকে বৈঠকগুলোয় আর আমন্ত্রণ জানানো হবে না, ভ্রমণ অনুমোদনও দেয়া হবে না। অন্যান্য কর্মীর অনেকেই এ কর্তব্যটুকু পালন করেছিলেন। কিন্তু বৈঠকে তাদের অপমানিতও করা হয়েছে। এমন একটা পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়েছিল যে, এ বিষয়ে কোনো কথাই বলা যাবে না।’

আর জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয়-বিষয়ক দপ্তর (ইউএনওসিএইচএ) প্রধানের মতো যারা বারবার এ নিয়ে কথা বলতেন, তাদের ইচ্ছা করেই আলোচনা সভাগুলো থেকে বাদ দেয়া হতো।

ভান্ডেনাবিলি আরো জানান যে, ইউএনওসিএইচএ-প্রধান কখন শহরের বাইরে যাবেন, সে বিষয়ে তাকে প্রায়ই খোঁজ নিতে বলা হতো। যাতে করে তিনি শহরের বাইরে গেলেই এসব বৈঠকের আয়োজন করা যায়।

ইউএনওসিএইচএ-প্রধান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে মিয়ানমারে জাতিসংঘে কর্মরত অনেকেই এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

ভান্ডেনাবিলি আরো জানান, রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন চালানোর সম্ভাব্যতা নিয়ে বারবার কথা বলায় তিনি নিজেও গোলমাল সৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়েন। একই সঙ্গে তাকে পদচ্যুতও করা হয়।

জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের মিয়ানমার সফরের সময়ও তাদের রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কথা বলা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। উত্তর কোরিয়ায় বর্তমানে নিযুক্ত জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক বিশেষ দূত টমাস কুইনটানা ২০১৪ পর্যন্ত মিয়ানমারে একই পদে নিয়োজিত ছিলেন। আর্জেন্টিনা থেকে তিনি জানান, মিয়ানমারে যাওয়ার পর ডেসালিয়েনের সঙ্গে তার বিমানবন্দরেই দেখা হয়।

টমাস কুইনটানা বলেন, ‘তিনি আমাকে উত্তর রাখাইনে না যাওয়ার উপদেশ দিয়ে বললেন, প্লিজ সেখানে যাবেন না। আমি এর কারণ জানতে চাইলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো ঝামেলায় না জড়ানোর অবস্থানটুকু ছাড়া তিনি কোনো ধরনের স্পষ্ট উত্তর দিলেন না। এটা তো শুধু একটা ঘটনা। কিন্তু এতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের কান্ট্রি টিমের কৌশলটুকু স্পষ্ট হয়ে ওঠে।’
এর পরও উত্তর রাখাইনে গিয়েছিলেন কুইনটানা এবং সে সময় ডেসালিয়েন কুইনটানার মিশন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। এরপর আর তাদের দুজনের মধ্যে দেখা হয়নি।

অন্যদিকে জাতিসংঘের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘আমরা আসলে রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়েই রাখাইন সম্প্রদায়ের সঙ্গে মাখামাখি চালিয়ে গেছি। সরকার জানে আমাদের কীভাবে ব্যবহার করতে ও নিজেদের কাজে লাগাতে হয়। তারা এটা বরাবরই করে গেছে, তার পরও আমাদের শিক্ষা হয়নি। সরকারকে ক্ষেপিয়ে তোলার ভয়ে আমরা কখনই তাদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারিনি।’

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনেও ইউএনসিটির কৌশলের সমালোচনা করে বলা হয়, ‘ইউএনসিটির কৌশল এক অতিসরলীকৃত ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে আছে যে, উন্নয়নের মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমন সম্ভব। এতে ইউএনসিটি যে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ হয়েছে তা হলো— একটি বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের পরিচালিত বৈষম্যমূলক কাঠামোয় বিনিয়োগের অর্থ হলো, বৈষম্যকে বদলে দেয়ার বদলে আরো শক্তিশালী করে তোলা।’

এপ্রিলে জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও ইউএনসিটির সমালোচনা করে নিজ দলের উদ্দেশে একটি মেমো পাঠান। ‘রিপোজিশনিং দি ইউএন’ শীর্ষক ওই নথিতে মিয়ানমারে জাতিসংঘের ভূমিকাকে ‘স্পষ্টতই অকার্যকর’ বলে উল্লেখ করা হয়।

এদিকে জাতিসংঘের এক সূত্র জানিয়েছে, জাতিসংঘের মিয়ানমার টিম এখন অভ্যন্তরীণ এক তদন্তের মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।-বণিক বার্তা
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে