নিউজ ডেস্ক: রোহিঙ্গাদের দেশান্তরী হওয়ার গল্পটা অনেক পুরোনো। বিশ্বব্যাপী এ নিয়ে টুকিটাকি আলোচনা সব সময়ই ছিল। বর্তমানে অধিকারহারা মানুষের আহাজারি আর লাশের গন্ধে ভারি হয়ে উঠেছে আরাকান। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান তাদের কষ্টের কথা। শিশু থেকে বুড়ো পর্যন্ত সবাই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এমনি এক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছে উত্তর রাখাইনের মংডুর বলিবাজারের বাসিন্দা শিশু রহিমুল্লাহ (১২)।
উখিয়ার বালুখালি শরণার্থী ক্যাম্পে ত্রাণ নিতে আসা রোহিঙ্গা শিশু রহিমুল্লাহ (১২) বলেন, কিভাবে বার্মার মিলিটারি তার সামনে তার বাবাকে হত্যা করেছে।
আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টার সেক্টর কোঅর্ডিনেশন গ্রুপ’ (আইএসসিজি) এর ২৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী মিয়ানমারের সেনা অভিযানে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে ৫৮ শতাংশেরই বয়স ১৮ বছরের নিচে।
এসব শিশুরা ভয়াবহ ও বীভৎস অভিজ্ঞতা এবং মানসিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। রহিমুল্লার মতো অনেক রোহিঙ্গা শিশুর সামনেই তার বাবা-মা বা পরিবারের অন্য সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।
রহিমুল্লাহর বাড়ি উত্তর রাখাইনের মংডুর বলিবাজারের কাছে। প্রায় ১০ দিন হলো সে এই শরণার্থী ক্যাম্পে এসেছে। বলিবাজার থেকে এই ক্যাম্পে আসতে তার পাঁচ দিন লেগেছে। ২৫ আগস্ট সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর প্রায় ১৫ দিন সে তার গ্রামে ছিল। এই সময় সে দেখেছে ভয়াবহ সব নৃশংসতা। সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে তাদের পাড়া সেনাবাহিনীরা ঘিরে ফেললে তিনি আর সেখানে থাকতে পারিনি। সেনাবাহিনীরা তার বাবাকে হত্যার এলোপাথাড়ি গুলি শুরু করে। পরিবারের এবং তার পাড়ার লোকজন যে যেদিকে পেরেছে সেদিকে দৌড়ে পালিয়েছে।
রহিমুল্লাহ বলে, ‘বার্মায় মিলিটারি গ্রামে গিয়ে আমার বাবাটাকে মেরে ফেলেছে। আমাদেরও যখন মারা শুরু করে, তখন যে যেদিকে পেরেছি দৌড় দিয়েছি। আমাদের গ্রামে ঘরের মধ্যে সকাল ৯টা-১০টার দিকে ভাত খাচ্ছিলাম। সেসময় মিলিটারি পুরো পাড়া ঘিরে ফেলে। পরে আমাদের ঘর থেকে বের করে বাবাকে কেটেছে। কাউকে কাউকে গুলি মেরেছে। পালিয়ে ওইদিন রাতটা আমরা পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে ছিলাম।’
’চুপে চুপে খালের কাছে এসেছি। খালের কাছে এসে যখন আমরা নৌকা পাই, তখন তারা বললো আমাদের ১০ হাজার টাকা করে দিতে হবে। আমরা বলেছি টাকা দিতে হলে দেব, শুধু আমাদেরকে একটু পার করে দাও। পরে টাকা দিয়ে আমার ভাই, বোন এবং মাসহ আমরা পালিয়ে এসেছি।’
রহিমুল্লাহ আরো বলেন, ‘আসার সময় নৌকার মধ্যে যখন আমরা উঠেছি, তখন আমাদের থেকে একটু দূরে আরেকটি নৌকা ছিল। সেই নৌকাটিতে মহিলা এবং পুরুষদের সঙ্গে অনেক ছোট বাচ্চা ছেলে-মেয়ে ছিল। কিন্তু মিলিটারি গুলি করে নৌকাটি গুঁড়িয়ে ডুবিয়ে দেয়। সেই নৌকায় যত বাচ্চা ছিল সবাই ডুবে মারা যায়। আর বাকি বড়রা যারা বেঁচে ছিল তাদেরকে ধরে কেটে কেটে পানির মধ্যে ভাসিয়ে দেয়।’
‘বোটে করে বাংলাদেশে আসার সময়ে বর্ডারে সীমান্তরক্ষীরা আমাদের ধরে রেখেছিল। সেখানেও টাকা দেয়ার পর আমাদের ছেড়ে দেয়। বালুখালিতে এসে প্রথম দিকে আমরা খাবার পাইনি, উপোস থেকেছি। এখন এখান থেকে (ত্রাণ) খাবার দিলে খাই, নইলে উপোস থাকি।’
গেলো ২৫ আগস্ট রাখাইনে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর এখন পর্যন্ত প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। রাখাইনে পুলিশের ৩০টি তল্লাশি চৌকি ও একটি সেনাক্যাম্পে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলায় ১২ পুলিশ নিহত হওয়ার পর ওই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
এর আগে গেলো বছরের ৯ অক্টোবরের পর থেকে মিয়ানমারের আরকান রাজ্যে একইভাবে হামলার ঘটনা ঘটে। এসময় প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসে প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা। এরপর আন্তর্জাতিক মহল নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে মিয়ানমার সরকারের ওপর। কিন্তু এর কোনো তোয়াক্কা না করে আরকানে ফের সেনা মোতায়েন করে নির্যাতন শুরু করে তারা।
এদিকে রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে কয়েকদিন ধরেই হিমশিম খাচ্ছিল কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। তবে সেনাবাহিনী দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে পাল্টে গেছে পুরো চিত্র। নির্দিষ্ট স্থানে পরিকল্পিতভাবে দেয়া হচ্ছে ত্রাণ।
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস