নিউজ ডেস্ক : রোহিঙ্গা বৃদ্ধ আব্দুর রাজ্জাকের বয়স জানা নেই। তবে তার ধারণা, বয়স ৯০ বছর ছাড়িয়ে গেছে। জীবনের এই শেষ সময়ে এসে যেখানে একটু আরাম-আয়েশে দিন কাটানোর কথা, সেখানে তিনি হয়েছেন জঘন্য নির্মমতার শিকার।
চার ছেলের রোজগারে ভালোই কাটছিল দিনগুলো। ছেলে বউ, নাতি-নাতনি নিয়ে সুখেই ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। কিন্তু হানাদার সেনাদের রোহিঙ্গানিধন অভিযানে সেই সোনালি দিনগুলো এখন কেবলই স্মৃতি। বর্তমানে তার দিন কাটে সেই সব স্মৃতি হাতড়ে, আর কেঁদে-কেটে।
ওপারে ভিটেমাটি ও স্বজনদের হারিয়ে এখন তিনি আশ্রয় নিয়েছেন উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। বুধবার (১ নভেম্বর) লম্বাশিয়া ক্যাম্পে দেখা হলে জীবনের করুণ কাহিনি এভাবেই বর্ণনা করেন আব্দুর রাজ্জাক। তার বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের আকিয়াব জেলার মংডু উপজেলার রাইম্মে ঘোনা গ্রামে। ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, গবাদিপশু সবই ছিল তার।
আব্দুর রাজ্জাক জানান, ৫-৬ বছর আগে স্ত্রী হাজেরা খাতুন মারা গেছেন। চার ছেলে ও দুই মেয়ের জনক তিনি। মেয়ে দু’টিকে বিয়ে দেওয়ার পর চার ছেলে, ছেলেদের বউ ও নাতি-নাতনিদের ঘিরেই তার জীবন কাটছিল। মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিদের হারিয়ে ফেলেন তিনি। এখন তারা কোথায় আছে, কিছুই জানা নেই রাজ্জাকের। অনেক খুঁজেছেন তাদের, কিন্তু কোথাও পাননি।
আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘হঠাৎ করে বড় একা হয়ে গেছি। মরলে দাফন-কাফন করারও কেউ নেই।’
এতো কিছুর পরও রাখাইন রাজ্যে ফিরতে চান আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘আমি যে কোনও উপায়ে মিয়ানমারে ফেরত যেতে চাই। আমার গ্রাম, আমার দেশ এবং জন্মভূমি, আমার বাল্যকালের স্মৃতিজড়িত রাখাইনেই মরতে চাই। কারণ, সেখানে আমার বাবা-মায়ের কবর রয়েছে। মারা গেলে বাবা মায়ের পাশেই যেন আমাকেও কবর দেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘কবে মিয়ানমারে ফিরতে পারবো, এই চিন্তায় অস্থির হয়ে আছি। আবার কবে আমার সন্তান, নাতি-নাতনিদের কাছে পাবো, জানি না। আমি জানি না, এখন তারা কোথায় আছে, কেমন আছে।’
আব্দুর রাজ্জাক জানান, তিনি যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আছেন, সেখানে তার আত্মীয়-স্বজন দূরের কথা, আশপাশের গ্রামের পরিচিত কেউও নেই।
অনেকটা হুট করে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার সরকারের কথার ঠিক নাই। আজ এক কথা বলে তো কাল বলে আরেক কথা। বিশ্বে মিয়ানমার সরকারই বেশি মিথ্যা কথা বলে। মিয়ানমার সরকার যে আমাদের ফেরত নেবে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। আমার এই বয়সে কখনও প্রমাণ পাইনি, মিয়ানমার সরকার কোনও কথা দিয়ে তা রেখেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মিয়ানমার সরকার আমাদের বার বার ধোঁকা দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের কারণে মিয়ানমার সরকার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে আছে। বাংলাদেশ সরকারের এখন উচিত, এই চাপকে অব্যাহত রাখার জন্য তৎপর থাকা। তবেই হয়ত মিয়ানামারে আমরা ফেরত যেতে পারব।’
তিনি জানান, মিয়ানমার সরকারের মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে বাংলাদেশের বিশ্বাস করাটা ঠিক হবে না। আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখার জন্যই বরং বাংলাদেশের তৎপর থাকা উচিত। তিনি বলেন, ‘এই সময়ে আমরা যদি মিয়ানমারে ফেরত যেতে না পারি, তবে আর কোনোদিনও যেতে পারবো না।’
শুধু আব্দুর রাজ্জাক নয়, তার মতো আরও অনেক বয়স্ক রোহিঙ্গা রয়েছেন উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। হারিয়ে ফেলা সন্তান ও স্বজনদের স্মৃতি হাতড়ে দিন কাটে তাদেরও। এসব বয়স্ক রোহিঙ্গারা জানান, তারা যে কোনও উপায়ে নিজ ভিটেমাটিতে ফিরে যেতে চান।
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস