কক্সবাজার : রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় হলেও কারো চাপে থামছে না রাখাইন সেনারা। এখন তারা নতুন এলাকায় শুরু করেছে নির্যাতন। দিন-রাত থেমে থেমে রোহিঙ্গাদের আবাসিক এলাকায় হামলা করছে রাখাইন সেনারা। আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে বাড়িঘরে। সেনারা রোহিঙ্গাদের ধরে নিয়ে হত্যা করছে। আর লাশ স্তূপ করে আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে। বর্বরতার মুখে রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা এ কথা জানিয়েছেন।
বেশ কিছু দিন বন্ধ থাকার পর বৃহস্পতিবার থেকে আবারো নতুন করে রাখাইনে শুরু হয়েছে সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন। তারা অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করছে। এতে করে প্রাণ বাঁচাতে প্রতিদিন দলে দলে আসছে রোহিঙ্গারা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আবারো বাংলাদেশ অভিমুখে রোহিঙ্গাদের ঢল নামতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সীমান্তের অনেকেই।
মিয়ানমারের আরাকানে আড়াই মাসেরও অধিক সময় ধরে চলা রোহিঙ্গা নির্যাতন এখনো বন্ধ হয়নি। যারা এখনো বাপ-দাদার ভিটে-বাড়ি ফেলে আসতে রাজি নয় এমন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আবারো শুরু করেছে ধ্বংসযজ্ঞ। জীবন বাঁচাতে তাই দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এখনো বাংলাদেশে আসছেন রোহিঙ্গারা।
মিয়ানমারের সেনাদের চরম অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ এমনকি শিশুও। এখন নতুন এলাকায় শুরু হয়েছে নির্যাতন। দিন-রাত থেমে থেমে রোহিঙ্গাদের আবাসিক এলাকায় হামলা করছে রাখাইন সেনারা। আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে বাড়িঘরে। সেনারা রোহিঙ্গাদের ধরে নিয়ে হত্যা করছে। আর লাশ স্তূপ করে আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে। বর্বরতার মুখে রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা এ কথা জানিয়েছেন।
রোহিঙ্গা নারী রোকসানা বেগম ও রহিম উদ্দিন জানান, তারা রাখাইনে রাতে ঘুমাতে পারেন না, খেতে পারেন না। মিয়ানমারের সেনারা রাস্তার পাশে স্থলমাইন পুঁতে রাখছে। আবারো তারা রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে এবং গলা কেটে হত্যা করছে। বাড়িতেও আগুন দিচ্ছে। অনেককে হত্যার পর লাশ স্তূপ করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। তাই কোনো রকমে তারা প্রাণটা নিয়ে এ দেশে এসে স্বস্তি পেয়েছেন।
সম্প্রতি আরাকানের বুচিডং, রাচিডং ও মংডুর মুসলিম আবাসিক এলাকায় এ ধরনের একাধিক ঘটনায় যারা এখনো অক্ষত আছেন, তারা চরম আতঙ্কিত। প্রতিদিন অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্গম পাহাড়ি বা পানিপথ পাড়ি দিয়ে পালিয়ে আসছে আশ্রয়ের সন্ধানে বাংলাদেশে। সীমান্তজুড়ে এখনো অপেক্ষায় রয়েছেন লাখো রোহিঙ্গা।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, ঢুুকার অপেক্ষায় সীমান্তের শূন্য রেখায় অবস্থান করছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা। গত এক সপ্তাহে ভেলায় ভেসেই এসেছেন দেড় হাজারের বেশি। বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিনই বাড়ছে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা।
এ দিকে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার মিয়ানমার সীমান্তের কাছে পাহাড়ে আশ্রয় নেয়া ৭৮টি রোহিঙ্গা পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে। তারা তীব্র খাদ্য সঙ্কট ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
উপজেলার দুর্গম দোছড়ি ইউনিয়নের ‘বাহির মাঠ’ এলাকার ছোট ছোট ঝুপড়িতে প্রায় চার শ’ মানুষ গত আড়াই মাস ধরে অবস্থান করছেন। উপজেলা সদর হতে ক্যাম্পটিতে যাতায়াতের সুবিধা না থাকায় দাতা প্রতিষ্ঠান ও মানবতার টানে ছুটে যাওয়া সাধারণ মানুষ সেখানে পৌঁছতে পারছে না। ফলে খাদ্যের অভাব তীব্র আকার ধারণ করেছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সেখানে দুর্গম পাহাড়ের ঢালুতে ৪০-৫০টি ঝুপড়ি ঘর। এসব ঘরে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে ৭৮ রোহিঙ্গা পরিবারের। শিবিরে থাকা বেশির ভাগ শিশুর গায়ে জামা নেই। ভুগছে নানাবিধ রোগে। খাদ্য সঙ্কট ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে তারা।
বাহির মাঠ ত্রাণশিবিরের একটি ঝুপড়িতে স্ত্রী ও ছয় ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকেন শামসুল আলম (৪৫)। তার বাড়ি বার্মার আরাকান রাজ্যের কুমিরখালী গ্রামে। সেখানকার একটি মসজিদের ইমাম ছিলেন তিনি। গত ২৫ আগস্ট সেনাবাহিনী তাণ্ডব শুরু করলে তিনি পরিবার নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নেন নাইক্ষ্যংছড়িতে।
রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, এখানে খাবার পানির তীব্র সঙ্কট। দোছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ গত সেপ্টেম্বর মাসে একটি নলকূপ স্থাপন করে দিলেও সেটি নষ্ট হয়ে গেছে। পাহাড়ি একটি ছড়ায় বাঁধ দিয়ে পানির চাহিদা পূরণ করছেন তারা। নোংরা পানি খেয়ে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন শিবিরের বাসিন্দারা।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, আরাকান রাজ্যে সহিংসতা শুরু হওয়ার পরদিন ৭৮টি পরিবারের ৩৬২ রোহিঙ্গা ৪৯ নম্বর সীমান্ত পিলারের কাছাকাছি বাহির মাঠ এলাকার আশ্রয় নেয়। কয়েক দিন আগে এই শিবিরে জন্ম নেয় দুই শিশু। এখন এই ত্রাণশিবিরের বাসিন্দা ৩৬৪ জন। এর মধ্যে শিশু ১৭১, নারী ১০০ ও পুরুষ ৯৩ জন। দুর্গম এই শিবিরের বাইরে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে আরো দু’টি রোহিঙ্গা ত্রাণশিবির রয়েছে। এর মধ্যে উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের বড় ছনখোলায় রয়েছে প্রায় সাত হাজার রোহিঙ্গা এবং সাপমারাঝিরি আশ্রয়শিবিরে থাকছে আরো তিন হাজার রোহিঙ্গা। এই দু’টি শিবিরে থাকা রোহিঙ্গারাও খুব একটা ত্রাণ পাচ্ছেন না।
জানা গেছে নাইক্ষ্যংছড়ির তিনটি শিবিরে থাকা সব রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারের উখিয়ার শিবিরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় তিন হাজার রোহিঙ্গাকে উখিয়ায় স্থানান্তর করা হয়েছে। তাই দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর নজরে আসছে না নাইক্ষ্যংছড়িতে আশ্রিত রোহিঙ্গারা।
নাইক্ষ্যংছড়ির দোছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদেশী নাগরিক ও দাতা সংস্থার প্রবেশাধিকার সীমিত থাকায় বাহির মাঠে থাকা রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিতে অনেকে যেতে পারছেন না। সেখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থাও খুব খারাপ। ফলে ওই শিবিরের ৩৬৪ জন রোহিঙ্গা ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এই দিকে জেলার বিভিন্ন স্থানে বাসা ভাড়া নিয়ে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট ক্যাম্পে নিয়ে যেতে কাজ করছে প্রশাসন। গত দুই দিনে ছয় শতাধিক রোহিঙ্গাকে বিভিন্ন ভাড়া বাসা থেকে ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। গত ১৩ নভেম্বর টেকনাফে রোহিঙ্গাদের বাসা ভাড়া দেয়ার দায়ে তিনজনকে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ১২টি ক্যাম্পে বর্তমানে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন। এসব রোহিঙ্গার মধ্যে ২৩টি পয়েন্টে চলছে নিয়মিত ত্রাণ বিতরণ। শীতবস্ত্র বিতরণের প্রতিও বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে জানিয়ে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: নিকারুজ্জামান জানান, ত্রাণ কার্যক্রমে এখন পুরোপুরি শৃঙ্খলা ফিরেছে।
উল্লেখ্য, গত ২৫ আগস্ট আরাকানে সীমান্তরক্ষী-বিজিপির ক্যাম্পে সন্ত্রাসী হামলার জেরে মিয়ামারের সেনারা নির্বিচারে রোহিঙ্গা নিধন শুরু করে। গত দুই মাসে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন।
এমটিনিউজ২৪/টিটি/পিএস