নিউজ ডেস্ক : অধিকারের বিষয়টি একেক জনের কাছে একেক রকম। বিশ্বের শীর্ষ ধনী মার্কিন ধনকুবের মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের সন্তান হয়ে যে শিশু এ পৃথিবীর আলো দেখে তার কাছে অধিকার এক রকম, আর রাজধানী ঢাকার ব্যস্ত গলি অথবা ফুটপাতে রাত কাটানো কোন মায়ের কোলে জন্ম নেওয়া সন্তানের কাছে অধিকার অন্য রকম। কেউ পৃথিবীর আলো দেখে সোনার চামচ মুখে নিয়ে, আর কারও জীবনই হয়ত কেটে যায় সোনার চামচের সন্ধান করতে করতে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র, প্রতিটি মুহূর্ত মানুষকে অধিকারের শিক্ষা দেয়। কেউ অধিকার পেয়ে খুশি কেউ অন্যকে অধিকার বঞ্চিত করে খুশি। এমনই একটি ভাগ্যহত জাতি রোহিঙ্গা যারা আজও লড়ছে তাদের অধিকার আদায়ে।
কুতুপালং ক্যাম্পে তখন শুধুই ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তনাদ। যে মানুষগুলোর কথা বলছি এরা কি আসলেই নিজেদের মানুষ মনে করে! মানুষ হিসেবে তাদেরও যে কিছু অধিকার থাকার কথা! থাকার কথা কিছু আবেগ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নিজেদের নেতা নির্বাচনের অধিকার, তারা কি তা জানে? বা কখনও কি জানার আগ্রহও হয়েছে? নাকি বেঁচে থাকার অধিকার আদায়েই তারা ব্যতিব্যস্ত। যুগ যুগ ধরে শোষণ বঞ্চনার শিকার এ রোহিঙ্গারা হয়ত নিজেদের মানুষ মনে করতেই কুণ্ঠাবোধ করবে, তারা নিজেদের হয়ত এমন এক শ্রেণীর মানুষ মনে করে যাদের জন্মই হয়েছে নির্যাতিত একটি জাতির ইতিহাসের অংশ হতে! যাদের জন্মই হয়েছে না পাবার গল্প বলতে! যাদের জন্মই হয়েছে সেনাবাহিনীর তাড়া খেয়ে জীবন বাঁচাতে অন্য কোন দেশে অসুস্থ শতায়ু মাকে কাঁধে নিয়ে দিনের পর দিন মাইলের পর মাইল হাঁটতে!রোহিঙ্গা-মিয়ানমার
জন্মগ্রহণের পর মানুষ হিসেবে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার মতো মৌলিক কিছু বিষয় যে তাদের অধিকার; কোন দয়া নয়, অথবা রাষ্ট্রেরই এ অধিকারগুলো তার নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করতে হয় এ নিয়ে কি তারা কখনও ভেবেছে, নাকি ভাবার অবকাশ তারা পেয়েছে! রহিম নামের এক রোহিঙ্গার কাছে জানতে পারি মজার এক তথ্য। তার ভাষায় রোহিঙ্গাদের বিনোদনের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। বছর বছর সন্তান জন্মদানই তাদের কাছে বিনোদনের!
রোহিঙ্গাদের বেড়ে ওঠাই শোষিত হবার জন্য। সেনাবাহিনী নামটি তাদের কাছে বরাবরই আতঙ্কের। বাংলাদেশে এসে যে মানবিক সেনাবাহিনী তারা দেখেছে, এ সেনাবাহিনী তাদের কাছে সম্পূর্ণই অপরিচিত। সেনাবাহিনী বলতে তারা যা বুঝে এসেছে তা ছিলো এমন এক বাহিনী যারা তাদের কেবলই নির্যাতন করে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীও তো বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মত ইউনিফর্ম পরে। দু’দেশের দুই সেনাবাহিনীর মধ্যে এত তফাত হয়ত রোহিঙ্গাদের নিঃসন্দেহে ভাবিয়েছে।
কোন রোহিঙ্গা কন্যা যখন ষোড়শী হয়ে ওঠে অথবা সৌন্দর্যের আলোয় চারিদিক আলোকিত করার জন্য প্রস্তুত হয় তখন হয়ত সেখানকার সেনাবাহিনীও প্রস্তুত হয় তাদের তুলে নিতে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে গিয়ে এ ধরণের গল্পই শুনেছি অনেক রোহিঙ্গার মুখে। এটাকে তারা নিয়তি বলেও মেনে নিয়েছেন। এরিস্টটল বা প্লুটোর মতো পণ্ডিতের নাম এদের অনেকেই হয়ত শোনেননি। তাদের মনোজগতে কখনও এদের নিয়ে আগ্রহই হয়ত জন্মায়নি। বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন কোন দেশের বিজ্ঞানী, কী আবিষ্কার করে তিনি নোবেল জিতেছেন? এ প্রশ্নগুলো অধিকাংশ রোহিঙ্গার কাছে ভিন্ন জাগতিক বিষয়ই মনে হবে। হয়ত আইনস্টাইনের নামই শোনেননি এমন রোহিঙ্গাই সেখানে বেশি। যে জাতির ইতিহাস বঞ্চনার, যে জাতির ইতিহাস চার দেয়ালের কাঁটাতারে বেড়া দেওয়া, সে জাতির ইতিহাসে মৌলিক অধিকার আর তার সাথে সৃজনশীলতার আশা করা কতটাই না বেমানান!
ক্যাম্পগুলোতে যে রোহিঙ্গাদের আমি দেখেছি, এদের কারো চোখেই আমি আইনস্টাইন হওয়ার স্বপ্ন দেখিনি, এদের কারো চোখেই ওপেন হেইমারের মতো পারমানবিক বোমা বানিয়ে কোন দেশ ধ্বংস করে দিতে পারে এমন অস্ত্র তৈরি করা ইচ্ছাও দেখিনি, দেখেছি শুধুই হাহাকার, দেখেছি ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের কষাঘাত। তারা চায় বাঁচতে, সবাইকে সঙ্গে নিয়েই তাদের এ চাওয়া। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের মত মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে চায় না তারা। প্রশ্ন ছিলো যারা সেনাক্যাম্পে হামলা করলো তারা কারা? না, এ প্রশ্নেরও কোন উত্তর অধিকাংশ রোহিঙ্গার কাছেই নেই। তারা শুধু ফিরতে চায় নিজ ঠিকানায়। কোন অজুহাতে তাদের ভিটামাটি ছাড়া করার এ রাজনীতিতে তারা বিশ্বাসী নয়। শত শত বছরের রোহিঙ্গাদের ইতিহাস মুছে দিয়ে তাদের বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া বাঙালি বলে চালিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রও তারা মানতে নারাজ।রোহিঙ্গা-মিয়ানমার
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুথিদংয়ের নেইন চং গ্রামের আনোয়ার হোসেন আশ্রয় নিয়েছেন উখিয়ার পানবাজারে সড়কের পাশে। তার বাম চোখের নিচে আঘাতের চিহ্ন। জিজ্ঞাসা করি, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের চিহ্ন কিনা। তিনি জানালেন, বর্মি পুলিশের গুলি লেগেছিল বহু বছর আগে। যেবার অং সান সু চির ‘ময়ূর’ নির্বাচনে জিতেও ক্ষমতায় যেতে পারেনি, সেবার পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে আঘাত পান। শুধু জালাল নন, শত শত রোহিঙ্গা ১৯৯০ সালে সু চিকে ক্ষমতায় আনতে রক্ত দিয়েছিলেন। ২৫ বছর পর ক্ষমতায় গিয়ে, সু চিই এখন রোহিঙ্গাদের রক্ত নিচ্ছেন। রোহিঙ্গাদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করছেন। ’৯০-এর নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক দল ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস পার্টি’ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত বুথিদং ও মংডু জেলায় চারটি আসনে জয়ী হয়। নির্বাচনে জয়ী সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসিকে (এনএলডি) সমর্থন জানায় রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক দল। অনেক রোহিঙ্গা নিজেদের দলকে বাদ দিয়ে সু চি’র ময়ূর মার্কাকে ভোট দেন। সেনাবাহিনী নির্বাচনের ফল বাতিল করে। এনএলডিকে ক্ষমতায় যেতে দেয়নি।
ছয় ক্লাস পড়া ৫৫ বছর বয়েসী মোহাম্মদ জালাল জানালেন, নির্বাচনের ফল বাতিলের পর বুথিদং ও মংডু শহরে রোহিঙ্গা নেতা শামসুল আনোয়ার, মো. ইব্রাহিমদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ হয়। কঠোর দমনপীড়ন চালায় সেনা সরকার। টাউনশিপ ছাড়িয়ে গ্রামগুলোতেও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন নেমে আসে। গ্রামে গ্রামে পুলিশ আসে। সু চি সমর্থক এবং ডেমোক্রেসি অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস পাটির সমর্থকদের বাড়িঘরে হানা দেয়। শত শত রোহিঙ্গা তরুণকে আটক করা হয়। সু চিকে সমর্থনের ‘অপরাধে’ বছরের পর বছর জেল খেটেছেন রোহিঙ্গা যুবকরা। সেনা ক্যাম্পে নিয়ে সু চির সমর্থক রোহিঙ্গাদের নিয়ে মারধর করা, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, মা-বোনদের নির্যাতন ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। অনেকেই পুলিশের অত্যাচারে মারা যান।রোহিঙ্গা-মিয়ানমার-মিয়ানমারের সেনাবাহিনী
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২৫ আগস্ট গণহত্যা শুরুর পর বালুখালী, কুতুপালং ও ঠেংখালী ক্যাম্পে যে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছেন তাদের অনেকের সঙ্গেই কথা বলে কিছু বিষয়ে মিল পাওয়া গেল। ক্যাম্পে অনেকেই আছেন যারা এক সময় সু চির সমর্থক ছিলেন। নির্যাতন ভোগ করেছেন। রক্ত দিয়েছেন। ক্ষমতায় এসে সু চি বেমালুম তাদের কথা ভুলে গেছেন। সু চি এখন রক্তাখেকোর ভূমিকায়। যে রোহিঙ্গারা সারাজীবন তাকে সমর্থন করেছেন, তাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করছেন না। যে মুসলিম সম্প্রদায় সু চিকে নিঃশর্ত সমর্থন করে, তাদের কোনো কথাই শুনতে নারাজ সু চি। মোহাম্মদ জালালের সহায়তায় সন্ধ্যায় বালুখালী ক্যাম্পে আরও চারজনকে পাওয়া গেল, যারা নব্বইয়ের দশকে সু চির সমর্থক ছিলেন। ডেমোক্রেসি অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস পার্টিকে ভোট দিয়েছিলেন ’৯০ সালের নির্বাচনে। তাদের সবার বয়েস পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে। তবে নির্যাতন-নিপীড়নের ক্লিষ্ট মুখ দেখে মনে হয় বয়স সত্তর ছাড়িয়েছে।
বালুখালী ক্যাম্পে বিদ্যুৎ নেই। যেসব রোহিঙ্গা পরিবার নিজ বাস্তু ছাড়ার সময় সঙ্গে মহামূল্যবান সোলার প্যানেলটি বয়ে আনতে পেরেছেন শুধু তাদের ঘরেই আলো জ্বলছে। রাতের অন্ধকারে শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং সু চির জন্য রোহিঙ্গাদের রক্ত দেওয়ার ইতিহাস আলোচনা। ছোট শিশু, কিশোর, তরুণরাও যোগ দেন তাতে। চারজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তথ্য পাওয়া গেল নুরুল কবিরের কাছে। তিনি জানালেন, যখনই মিয়ানমারে নির্বাচনের দাবিতে কিংবা সেনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে তখনই রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার নেমে এসেছে। রোহিঙ্গাদের প্রায় সবাই সু চির সমর্থক- এ কারণে মিয়ানমারের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় তাদের ওপর অত্যাচার বেশি হয়েছে।রোহিঙ্গা-মিয়ানমার
নুরুল কবির খুব বেশি পড়াশোনা জানেন না। ১৯৯০ সালের নির্বাচনের আগেও খুব বড় ধরনের একটি আন্দোলন হয়েছিল গণতান্ত্রিক নির্বাচনের দাবিতে। নুরুল কবির জানালেন, তার ছোট ভাই আনোয়ারুল কবির ১৯৯০ সালের নির্বাচনের সময় পুলিশের নির্যাতনে মারা যান। আনোয়ার ওই নির্বাচনে রোহিঙ্গা প্রার্থীদের পক্ষে ভোটের প্রচার চালান। নির্বাচনের ফল বাতিলের পর একদিন তাকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। আকিয়াবে জেলে আটকা রাখা হয় কয়েক মাস। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। আবদুল খালেক জানালেন, ২০০৮ সালে যখন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা আন্দোলন করেন সেনা শাসকের বিরুদ্ধে, তখনও রোহিঙ্গাদের অত্যাচার করা হয়। মুকিমুল কাদের দীর্ঘশ্বাস ফেলে রোহিঙ্গা ভাষায় যা বললেন তার সারমর্ম হলো, রোহিঙ্গাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পুরো জীবনটাই কষ্টের। মিয়ানমারে যখনই সরকারের বিরুদ্ধে সামান্য আন্দোলন হয়েছে, তখনই রোহিঙ্গাদের ওপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতন হয়েছে। রোহিঙ্গারা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করুক বা নাই করুক।
২০১১ সালের নির্বাচনের আগেও ঘরে ঘরে তল্লাশি করার নামে নির্যাতন করা হয়। ২০১৫ সালের নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ভোট দেওয়ার সুযোগ ছিল না। এর আগের বছরগুলোতে তাদের ওপর কঠোর সব বিধিনিষেধ আরোপ করায়, নির্বাচনের সময় সু চির পক্ষে কাজ করার সুযোগ ছিল না। মোস্তাফিজুর রহমান বললেন, ভোট দিতে না পারলেও তারা দোয়া করেছিলেন সু চি যেন জয়ী হয়। আশা ছিল সু চি ক্ষমতায় এলে তাদের সমস্যার সমাধান হবে। স্বীকৃতি পাবেন জন্মভূমির। কিন্তু দেড় বছরে সু চি সব আশা শেষ করে দিয়েছেন। রোহিঙ্গারা সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হচ্ছে, তার আমলেই। গত এক বছরে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা দেশছাড়া হয়েছে, বলছিলেন মোস্তাফিজুর। বলতে গিয়ে একটা সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। আর বলতে পারবে না জানিয়ে ৬ বছরের সন্তানকে বুকে চেপে ধরেন মোস্তাফিজুর।
এমটিনিউজ২৪/টিটি/পিএস