নিউজ ডেস্ক: নুর কায়দার বয়স এখন ১৩ বছর৷ নিজের বাবা-মাকে চোখের সামনেই জবাই হতে দেখেছে সে৷ রাখাইনের মগরা (উগ্রপন্থি বৌদ্ধ) হত্যা করেছে তাদের৷ সেই দৃশ্য দেখার পর কিছু দিন পালিয়ে বেড়িয়েছে নুর কায়দা৷ একপর্যায়ে দাদির সঙ্গে বাংলাদেশে চলে আসতে সক্ষম হয় সে৷
বাবা-মা ছাড়া নুর কায়দাকে দেখাশোনার কেউ ছিল না৷ দাদির পক্ষেও তার ভারবহন সম্ভব নয়৷ তাই কয়েকমাস আগে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছে৷ আলাপকালে এই কিশোরী অকপটেই স্বীকার করেন, ‘‘দাদির পক্ষে আমাকে খাওয়ানো সম্ভব ছিল না৷ এজন্য বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন৷''
শ্বশুড়বাড়িতে ভালো আছেন মনে করছেন নুর কায়দা৷ অন্তত খাওয়ার চিন্তা নেই৷ তবে জীবনটা যে একটু অন্যরকম হতে পারতো সেটাও ভাবে সে৷ জানালো, সুযোগ থাকলে লেখাপড়া করতাম৷ কিন্তু ভাগ্যে নেই৷
নুর কায়দার মতো তসলিমা আর মোমিরারও বিয়ে হয়ে গেছে কিছুদিন আগে৷ তারা নিজেদের বয়স ১৬ বলে দাবি করেছে৷ তবে, এই প্রতিবেদকের সঙ্গে থাকা এক স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন, তাদের বয়স আরো অন্তত দুই বছর করে কম হবে৷
তসলিমা এবং মোমিরা অন্তঃসত্ত্বা৷ তাদের বিয়ের কারণও একই৷ তাদের একজনের বাবা খুন হয়েছেন মগের হাতে, অন্যজন সামরিক বাহিনীর হাতে৷ ফলে তাদেরও দেখার কেউ নেই৷ সমাধান, বাল্যবিয়ে৷ মোমিরার কথায়, ‘‘বাপ নেই, মা খাওয়াতে পারে না, তাই বিয়ে দিয়ে দিয়েছে৷''
তসলিমা অবশ্য এখনো বেশ লাজুক৷ গুছিয়ে কথা বলতে পারে না৷ শুধু তাকিয়ে থাকে অপলক নয়নে৷ নিজের অনাগত সন্তানের ভবিষ্যত কী সে জানে না৷ শুধু জানে, বিয়ে করায় খাবারের সংকট ঘুচেছে৷ শরণার্থী শিবিরে পরিবার হিসেব করে ত্রাণ দেয়া হয়৷ তাই নিজের সংসার হওয়ায় ত্রাণ এখন বেশি পাওয়া যাচ্ছে৷
কেন এত বাল্যবিয়ে?
কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফ এলাকার রোহিঙ্গা শিবিরগুলো গত কয়েকমাসে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে৷ রোহঙ্গাদের স্রোত এত বেড়েছে যে, দেদারছে পাহাড় সাফ করে নতুন নতুন ক্যাম্প গঠন করে তাদের জায়গা দিতে হচ্ছে৷ গত তিনমাসে আসা ছয়লাখের বেশি শরণার্থীর নিত্যদিনের চাহিদা পূরণই সেখানে এক বড় চ্যালেঞ্জ৷
তবে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি বাল্যবিয়েকে নানাভাবে আলোচনায় নিয়ে আসতে চাচ্ছে কয়েকটি সংগঠন৷ এদের মধ্যে একটি সংগঠন ‘‘গার্লস নট ব্রাইডস৷'' লন্ডনভিত্তিক এই সংগঠনটি মনে করছে, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বাল্যবিয়ে বন্ধে উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে৷
সংগঠনটির উপ নির্বাহী পরিচালক হেথার হ্যামিল্টন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মানবিক বিপর্যয়ের সময় বাল্যবিবাহের হার উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যায়৷ মেয়েদের জন্য খাদ্য এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অনেক পরিবার তাদের বিয়ে দেয়ার পথ বেছে নেয়৷ কিন্তু তাতে তাদের শারীরিক ও মানসিক অনেক ক্ষতি হয়৷ আর বাল্যকাল এবং ভবিষ্যত ধ্বংস হয়ে যায়৷''
কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা জনপ্রতিনিধি, যারা মাঝি নামে পরিচিত, নুরুল ইসলামও বাল্যবিয়ের পেছনে খাদ্যসংকটের কথা জানালেন৷ তিনি বলেন, ‘‘মগদের জ্বালাযন্ত্রনায় ওরা মিয়ানমার থেকে চলে এসেছে৷ এখানে এসে খাওয়াদাওয়া করতে পারে নাই, অভাবে পড়েছে৷ এজন্য মায়েরা তাদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘সরকার যদি আমাদের যেভাবে রেশন দেবে বলেছিল, ১৫ দিন পরপর, সেখাবে দিলে বাল্যবিবাহ ঠেকানো যাবে৷ নাহলে ঠেকানো যাবে না৷ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১০ শতাংশ বিয়ে হয় স্বাভাবিকভাবে, আর বাকি ৯০ শতাংশ হয় অভাবের কারণে৷''
স্বাস্থ্যঝুঁকিতে কিশোরী মায়েরা
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে বিভিন্ন দেশি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা৷ এদের মধ্যে ব্রাক, সেইভ দ্য চিলড্রিন, ডক্টর্স উইদাউট বর্ডার্স, ইউনিসেফ এবং আইওএম উল্লেখযোগ্য৷ এসব প্রতিষ্ঠানের গড়া স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্রসুতি মায়েদের এবং শিশুদের জন্য চিকিৎসা সেবার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে৷
কুতুপালং ক্যাম্পে দু'বছর ধরে কাজ করছেন ড. রোমানা ইসলাম৷ অভিবাসী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন আইওএম-এর এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অল্পবয়সি মেয়েদের গর্ভধারণ নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন৷ কখনো কখনো দিনে ২৫ থেকে ৩০ জন কিশোরী অন্তঃসত্ত্বার চিকিৎসা করেন তিনি৷
ড. ইসলাম বলেন, ‘‘বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েরা প্রথমত অপুষ্টিতে ভোগে৷ যেহেতু তারা নিজেরাই ছোট এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক, তাদের বাচ্চাগুলোও ছোট এবং অপরিনত হয়৷ অনেকসময় তাদের ডেলিভালির সময় অনেক বেশি রক্তক্ষরণ হয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘তারা নিজেরা নিজেদের যত্নতো নিতেই পারে না, সন্তানের যে পরিমাণ যত্ন নেয়া দরকার, সেটাও নিতে পারে না৷''
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বাল্যবিবাহ কমাতে হলে জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷ পাশাপাশি মেয়েদের জন্য শিক্ষা এবং পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী ত্রাণের বন্টন বাড়ালে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে৷- ডয়চে ভেলে
এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস