শুক্রবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৬, ১০:৪২:২৭

সাঁওতাল পল্লীতে ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩

সাঁওতাল পল্লীতে ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩

তাজুল ইসলাম, গাইবান্ধা: সাঁওতালদের উচ্ছেদের সময় চিনিকলের কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্থানীয় প্রভাবশালীদের লোকজন ও পুলিশের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষে দুই সাঁওতাল নিহত এবং তাদের বাড়িতে হামলা ও লুটপাটের ঘটনায় এলাকায় বৃহস্পতিবারও থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। এদিকে বৃহস্পতিবার ভোরে আরও এক সাঁওতাল মারা যাওয়ার খবর এসেছে। এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়াল তিনে। তবে আগেই দুই সাঁওতাল নিহতের ঘটনায় এখনও থানায় মামলা হয়নি।

বৃহস্পতিবার আর এক সাঁওতাল নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাপমারা ইউনিয়নের শিন্টাজুরি গ্রামের মৃত মাঝি সরেনের ছেলে রোমেশ সরেন (৪০) গত রবিবার পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষে আহত হয়ে গ্রেফতারের ভয়ে গোপনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন বলে নিহতের পরিবারের দাবি। বৃহস্পতিবার ভোররাতে তিনি মারা যান।

তবে গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুব্রত কুমার সরকার বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে বলেন, রোমেশ সরেনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। সংঘর্ষে মারা যায়নি। এ নিয়ে পুলিশ ও সাঁওতালদের সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা দাঁড়াল তিন।

অপরদিকে চিনিকলের জমি দখল ও উচ্ছেদের দুই প্রক্রিয়ায় ভুল পথে সংঘটিত হয়েছিল বলে এক অনুসন্ধানে জানা যায়। আর তার বলি হয় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজন। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারে সাঁওতালদের দখল করা ভূমির ওপর শত শত একচালা ঘর পুড়িয়ে ফেলার পর ওসব ঘরের ধ্বংসস্তূপ চিনিকল কর্তৃপক্ষ ট্রাক্টর দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গত রবিবারের উচ্ছেদ ঘটনার পর সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার সংলগ্ন সাঁওতাল পল্লী মাদারপুর ও জয়পুর পাড়ায় বাসীদের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা স্থবির হয়ে গেছে। তারা কাউকেই আর বিশ্বাস করছেন না। সন্তানরা স্কুল-কলেজে যাচ্ছে না। তারা তাদের নিয়মিত কাজে ফিরতে পারছেন না। হাট-বাজারেও যান না তারা।

মাদারপুর গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতাল মামনি কিসকু, মিকাই মুরমু, সমি মরমু ও বাঙালি আজিরণ বেগম ও রুমানা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা গরীব মানুষ, কৃষি কাজ করে সংসার চলে। সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সভাপতি শাকিল আলম বুলবুলের ইন্ধনে তারা বাপ দাদার জমি ফেরত পাবার আশায় ধার-দেনা করে মিলের জমিতে চালা ঘর উঠায়। আবার তার নেতৃত্বেই রবিবার চালানো হয় উচ্ছেদ অভিযান।

সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সভাপতি শাকিল আলম বুলবুল ওই অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, গত ডিসেম্বর মাসে চিনিকলে চত্বরে আদিবাসী ও মিল কতৃপক্ষের এক আলোচনা সভায় অধিগ্রহণের শর্তের বিষয়টি পরিষ্কার হয়। মিল তার চুক্তি ভঙ্গ করলে জমি সরকারের কাছে ফেরত যাবে। ঠিক তার পরপর তিনি গত জানুয়ারী মাসে ওই কমিটির সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

তিনি আরও জানান, শাহজাহান আলী নামে স্থানীয় নরেঙ্গাবাদ গ্রামের এক ব্যক্তি ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক। যিনি জমিজমার কাগজ পত্র ভালো বোঝেন। অধিগ্রহণ চুক্তি পত্রের ৫ নম্বর শর্তের ভুল ব্যাখা দিয়ে দুই বছর আগে তিনি ইন্ধন দিয়ে এই আন্দোলন সংগঠিত করেন। এছাড়া সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ইক্ষু খামার জমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহ-সভাপতি ফিলিমন বাস্কও জড়িত ছিলেন।  তখন থেকে বাপ-দাদার দাবি করে এসব জমি ফেরত চেয়ে আন্দোলনে নামে সাঁওতাল নৃগোষ্ঠির লোকজন।

তারা দীর্ঘ দুই বছর উপজেলা ও জেলা শহরে দফায় দফায় মিছিল-সমাবেশ ও মানববন্ধন করে। তার দাবি পরবর্তীতে আদিবাসীদের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনসহ কয়েকটি বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলেরও ইন্ধন ছিল একাজে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে গত ১ জুলাই ওই ইক্ষু খামারের প্রায় ১০০ একর জমি দখল করার উদ্দেশ্যে নৃগোষ্ঠীর কিছু লোক একচালা ঘর নির্মাণ করে। তখন থেকে তারা তীর-ধনুক নিয়ে জমি পাহারাও দেওয়া শুরু করে।

এ প্রসঙ্গে সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ইক্ষু খামার জমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহ-সভাপতি ফিলিমন বাস্ক ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলী সরকার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয় নাই।

বুধবার ঢাকা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন ও প্রকৃত ঘটনা জানতে নাগরিক কমিটির সঙ্গে আসা ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জানান, সাওঁতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের ১ হাজার ৮শ’ ৪০ দশমিক ৩০ একর জমি ১৯৬২ সালে অধিগ্রহণ করে চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তুলেছিলেন। ওই অধিগ্রহণের চুক্তির ৫ নম্বর শর্তে উল্লেখ আছে, যে কারণে ওইসব জমি অধিগ্রহণ করা হল, কখনও যদি ওই কাজে জমি ব্যবহার করা না হয়। তাহলে অধিগ্রহণকৃত জমি সরকারের কাছে ফেরত যাবে। পরবর্তীতে সরকার এসব জমি পূর্বের মালিকের নিকট ফেরত দেবে।

তিনি আরও জানান, আমরা এর আগে এসে দেখে গেছি এসব জমিতে মিলের জন্য ইক্ষু চাষ না করে ধান ও তামাক চাষ করেছে এবং গাইবান্ধা জেলা প্রশাসকও এধরনের একটি তদন্ত রির্পোট প্রদান করেছে। মিল তার চুক্তি ভঙ্গ করেছে।

তিনি বলেন, জেলা প্রশাসক কিংবা আদালতের রায় ছাড়া কিন্তু কোনও ব্যক্তি উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে পারেন না। আমরা শুনেছি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছেন।

রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল আউয়াল বলেন, গত রবিবার (৬ নভেম্বর) চিনিকলের রোপন করা আখ বীজ হিসেবে সংগ্রহের জন্য কাটতে গেলে সাঁওতালরা বাধা দেওয়ার এক পর্যায়ে সংর্ঘষ বাঁধে। এসময় সাঁওতালরা পুলিশ ও চিনিকিলের শ্রমিক-কর্মচারীদের উপর তীর নিক্ষেপ করে। এতে ৯ পুলিশ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন তীর বিদ্ধ হন। এতে স্থানীয় জনগণও ক্ষিপ্ত হন।  

তিনি আরও দাবি করেন, মিলের জমি দখলের পর থেকে সাঁওতালরা স্থানীয় গ্রামবাসীর সঙ্গে বিরূপ আচরণ করতে থাকেন। সব মিলিয়ে সেদিন স্থানীয় গ্রামবাসী ক্ষুদ্ধ হয়ে তাদের উচ্ছেদ করে দিয়েছে। এদিকে পুলিশ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উপস্থিতি কথা স্বীকার করে তিনি দাবি করেন, তারা মূলত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যাতে অবনতি না হয় সেজন্য ওই এলাকায় উপস্থিত ছিলেন।

গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি সুব্রত কুমার সরকার মোবাইল ফোনে বলেন, রবিবার (৬ নভেম্বর) পুলিশ ও চিনিকিলের শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষে ৯ পুলিশ সদস্য বেশ কয়েকজন তীর বিদ্ধ হয়। এঘটনায় পুলিশ ওই এলাকায় আসামী গ্রেফতার করতে যায়। এর কোনও এক সময়ে সেদিন স্থানীয় ক্ষুদ্ধ গ্রামবাসী তাদের ঘরবাড়িতে আগুন দেয়। পুলিশ ওই সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে মাত্র। তার উচ্ছেদ অভিযানে অংশ নেয়নি।

গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান বলেন, রবিবার সকালের সংর্ঘর্ষের পর পরবর্তীতে যে কোনও ধরনের হাঙ্গামা ঠেকাতে ওই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। তিনি তখন ওই এলাকায় কর্তব্যরত ছিলেন মাত্র। বিকালে পুলিশ ওই এলাকায় আসামী গ্রেফতারে অভিযান চালান। এই সময় পার্শ্ববর্তী ৭/৮ গ্রামের লোকজন দখলদারদের একচালা ঘরগুলো পুড়িয়ে দেয়। প্রশাসন কোনও ধরনের উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে নাই।

তিনি আরও জানান, ইক্ষু খামারের ১ হাজার ৮শ’ ৪০ দশমিক ৩০ একর জমির মধ্যে আখ চাষের পর ৫৬শ” একর জমি পরিত্যক্ত থাকে। পরিত্যক্ত ওই জমিতে স্থানীয় গ্রামবাসী গরু-ছাগলকে ঘাস খাওয়ায়। আবার কেউ কেউ ওই ঘাস কেটে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু সাঁওতালরা দখল করার পর কোনও গ্রামবাসীকে ওই পরিত্যক্ত জমিতে আসতে দিত না। সেই ক্ষোভ থেকে তারা এ কাজ করেছে।

প্রসঙ্গত, গত রবিবার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রংপুর চিনিকলের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে তীরবিদ্ধ হয়েছেন ৯ জন পুলিশ সদস্য এবং গুলিবিদ্ধ হন ৪ জন সাঁওতাল। এছাড়া তিনজন সাঁওতাল নিহত হন।  এ ঘটনায় গোবিন্দগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক কল্যাণ চক্রবর্তী বাদী হয়ে রবিবার রাতে ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে সাড়ে ৩শ’ জনকে আসামি দেখিয়ে মামলা দায়ের করেন। এপর্যন্ত পুলিশ চার জনকে গ্রেফতার করেছে। -বাংলা ট্রিবিউন।
১১ নভেম্বর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে