আফরোজা লুনা, গাইবান্ধা : শিক্ষার আলোয় আমাদের সমাজের অনেক কুসংস্কার দূর হয়ে গেছে। কিন্তু মনের মধ্যে এখনো কুসংস্কার নামে অন্ধকার আমাদের তাড়িত করে। তাইতো এখনো ছেলেকে নির্মমভাবে হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে বেঁধে রেখেছে তার পরিবারের লোকজন।
ওই শিকলবন্দী যুবকের নাম বাবু। তার বাবা একজন সুশিক্ষিত অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। নিরাপত্তাজনিত কারণে ছেলের পায়ে এভাবে লোহার শেকল পরিয়ে আটকে রাখার কথা স্বীকার করেছেন তিনি। এরকম নির্মম ও বর্বর ঘটনা এখনো ঘটতে পারে তা অবিশ্বাস্য। কিন্তু জেলা শহর গাইবান্ধার মুন্সিপাড়ায় এরকমই ঘটনা ঘটেছে।
গাইবান্ধা শহরের মুন্সিপাড়ার বাসিন্দা সরোয়ার হোসেন। তিনি সোনালী ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা। তিন মেয়ে শাপলা, চেরি ও শিউলীকে বিয়ে দিয়েছেন। তারা স্বামী সংসার ও সন্তান নিয়ে ব্যস্ত। আর একমাত্র ছেলের নাম বাবু। আর দশজনের মতো বাবুও সবার সঙ্গে মেশে, খেলাধুলা করে, স্কুলে যায়।
হ্যাঁ সেই বাবুই্ আজ শেকলবন্দী। তার পা শিকল দিয়ে বাঁধা। একটা চেয়ারে বসে বিরবির করে সারাক্ষণ বই পড়ে। সামনে কেউ গেলেই বলে, ‘হাতের লেখা খারাপ। সেইজন্য আমার পায়ে শেকল দিয়ে চেয়ারের সাথে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।’
একমাত্র ছেলে বাবুর হঠাৎ কী হলো বাড়ির কেউ বুঝতে পারেনি। অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। তারপর শুরু হয় চিকিৎসা। ডাক্তার, কবিরাজ, ঝাড়-ফুক কোনটাই বাদ যায়নি।
সেই ২০০১ সালের কথা। সেসময় বাবু ৭ম শ্রেণিতে পড়তো। স্কুল থেকে বিকেলে বাড়ি ফিরে সে অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। ব্যস সেই থেকে স্কুল যাওয়া বন্ধ।
বাড়ির লোকজনের দাবি, তার উপর জিনে আছর করেছে। অর্থাৎ তাকে জিনে ধরেছে। আবার কেউ কেউ বলে শত্রুতা করে তাকে তাবিজ-কবজ করেছে। এইসব আজগুবি কাহিনি চেপে বসে তার অভিভাবকদের মাথায়। তারপর হোমিও-অ্যালোপ্যাথিসহ ঝাড়ফুকে চিকিৎসা চলতে থাকে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। ওষুধ খেয়েও বাড়িতে সে অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। তারপর হঠাৎ একদিন বাড়ি থেকে হাওয়া। তারপর খোঁজ চলতে থাকে। প্রায় এক বছর ধরে বাবুকে না পেয়ে বাড়ির লোকজন হতাশ হয়ে খোঁজাখুঁজি বন্ধ করে দেয়।
এরপর বাবু হঠাৎ আবার বাড়িতে এসে হাজির। বাড়ির সবাইতো অবাক। বাড়ির ছেলে বাড়িতে ফিরে এসেছে। তারা খুশিতে আটখানা। বাড়িতে স্বাভাবিক চলাফেরা শুরু হয় বাবুর। দীর্ঘ বছর দুয়েক বাড়িতে বাবা-মার সঙ্গে বসবাস করে স্বাভাবিকভাবে। প্রতিবেশী বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ির সামনে এবং মাঠে ক্রিকেট খেলে সময় কাটাতো। আবার কী হলো কেউ জানে না। বাড়ির সকলের অগোচরে বাবু হাওয়া হয়ে যায়।
প্রায় ৩ বছর পর তাকে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বেলকা এলাকায় একটি মসজিদের বারান্দায় তার খোঁজ মেলে। বেলকা এলাকার লোকজন জানায়, বাবু তার নাম বলতে পারতেন। তার ঠিকানা, বাবা-মার নাম বাংলা ছাড়াও ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন। দীর্ঘ প্রায় তিন বছর ওই এলাকার হাট-বাজার, মসজিদ ও মানুষের বাড়িতে রাত-দিন খেয়ে না খেয়ে দিন যায়।
পরে চলতি বছর মে মাসের শেষ দিকে বিভিন্ন জনের কাছে খবর পেয়ে তার বাবা সরোয়ার হোসেন ছেলেকে নিয়ে আসেন বাড়িতে। আর সেই থেকে মাসখানেক হলো বাবু কিছু ভৌতিক কথাবার্তা বলে। সে নাকি আবার চলে যাবে অন্যখানে। এখানে তার ভালো লাগে না।
এদিকে, তার বাবা-মার ধারণা তাকে জিন-পরীরা নিয়ে যেতে চায়। সে কারণে তার থাকতে ইচ্ছে করে না। জিন-পরী যেনো তাকে নিয়ে যেতে না পারে সেজন্য তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে শেকলে। -বাংলামেইল
৩০ জুন, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএম