নূর ইসলাম, যশোর থেকে : নির্বাচনী উত্তাপ বইছে যশোর-৩ সদর আসনে। জেলা সদরের এই আসনকে ঘিরে আবর্তিত হয় যশোরের রাজনীতি। ফলে এই আসনটি সব সময় দখলে রাখার চেষ্টা করেন বড় দুটি দল। তবে বিগত দিনের ভোটের হিসেবে এই আসনটির মূল দাবিদার আওয়ামী লীগ।
বিগত ৫টি জাতীয় নির্বাচনের সারসংক্ষেপ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ২০০১ সাল ছাড়া বাকি সব নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিজয় হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী নির্বাচনেও আসনটি নিজেদের দখলে রাখার সব রকমের চেষ্টা করবেন নৌকার প্রার্থী ও তার কর্মী সমর্থকরা। তবে সেই ক্ষেত্রে সব থেকে বড় অন্তরায় দলের অভ্যন্তরীণ লবিং গ্রুপিং। আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন লাভ করাকে কেন্দ্র করে এই বিরোধ আরো বাড়তে পারে বলে মনে করছেন দলের জেলা পর্যায়ের একাধিক শীর্ষ নেতা।
অপরদিকে হারানো গৌরব ফিরে পেতে মরিয়া বিএনপি। ইতিমধ্যে দলের সকল স্তরের নেতাকর্মী একাট্টা হয়ে শুরু করেছেন দলীয় প্রস্তুতি। প্রবীণ নেতা সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামকে ঘিরে নেতাকর্মীরা স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করেছেন। তারা মনে করেন আগামী নির্বাচনে যশোর-৩ সদর আসন থেকে তরিকুল ইসলাম ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হবেন। আর বিএনপি সরকার গঠন করতে পারলে তরিকুল হবেন মন্ত্রী।
এদিকে বিএনপিতে একক প্রার্থী থাকলেও আওয়ামী লীগের প্রায় হাফ ডজন নেতা মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন। এরা হচ্ছেন বর্তমান এমপি বিশিষ্ট শিল্পপতি ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব কাজী নাবিল আহম্মেদ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন চাকলাদার, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন, সাবেক এমপি খালেদুর রহমান টিটো, যশোর পৌরসভার সাবেক মেয়র বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা কামরুজ্জামান চুন্নু, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের সদস্য অ্যাডভোকেট বাবু পিযুষ কান্তি ভট্টাচার্য্য, যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও যশোর আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট শরীফ আব্দুর রাকিব এবং জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য প্রয়াত সভাপতি আলী রেজা রাজুর সহধর্মিণী আফরোজা রেজা।
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা নানা কর্মসূচি নিয়ে হাজির হচ্ছেন ভোটারদের কাছে। করছেন নানা প্রকারের দান দক্ষিণা। মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন নেতারা। চলছে পোস্টারিং আর ফেসবুকের মাধ্যমে প্রচার প্রপাগান্ডা। চায়ের স্টলগুলোতে নির্বাচনী আলাপ আলোচনায় উঠছে ঝড়। সব কিছু ছাপিয়ে এই নির্বাচনী এলাকার প্রধান সমস্যা মাদক, সন্ত্রাস, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, দুর্নীতি আর দলীয় করণের মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু উঠে আসছে আলোচনায়।
বিগত দিনে যারা এসব এলাকায় বিভিন্ন পদে জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বা বর্তমানে করছেন তাদের নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিগত দিনে ভোটারদের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি কোন নেতা কতটুকু পূরণ করতে পেরেছেন তারও হিসাব কষছেন ভোটাররা।
যশোর সদর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে জাতীয় সংসদের ৮৭ যশোর-৩ নির্বাচনী এলাকা গঠিত। এখানকার মোট ভোটার ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৪৭০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ২ লাখ ৫৫ হাজার ৪২৬ জন। আর নারী ভোটারের সংখ্যা ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪৪ জন। জেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে চলমান ভোটার তালিকা হালনাগাদ প্রক্রিয়ায় আরো কিছু ভোটার বাড়তে পারে।
এই নির্বাচনী আসনটির মুল দাবিদার আওয়ামী লীগ। দেশ স্বাধীনের পর থেকে এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই বেশি বার জয়লাভ করেছেন। সর্বশেষ ২০০৮ সালের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে এই আসনে নৌকার প্রার্থী হিসেবে খালেদুর রহমান টিটো এমপি নির্বাচিত হন। তার আগের নির্বাচনে তরিকুল ইসলাম বিপুল ভোটের ব্যবধানে নৌকার প্রার্থী আলী রেজা রাজুকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এই আসন থেকে নৌকার প্রার্থী হিসেবে রওশন আলী ও আলী রেজা রাজু এমপি নির্বাচিত হন।
তবে রওশন আলীর মৃত্যুর পর এই আসনে এমপি হন তরিকুল ইসলাম। অপরদিকে যশোর পৌরসভা নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীরা বিভিন্ন সময় নির্বাচিত হয়ে নিজেদের দলীয় অবস্থান সুদৃঢ় করার চেষ্টা করেছেন। যশোরের ত্রিরত্ন খ্যাত তিন বাল্যবন্ধু তরিকুল ইসলাম, খালেদুর রহমান টিটো ও আলী রেজা রাজু পর্যায়ক্রমে যশোর পৌরসভার চেয়ারম্যান বা মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। তার পরবর্তী জেনারেশন হিসেবে কামরুজ্জামান চুন্নু, মারুফুল ইসলাম মারুফ ও জহিরুল ইসলাম চাকলাদার রেন্টু মেয়র হয়েছেন।
এছাড়া স্থানীয় ইউপি নির্বাচনেও যশোর সদর উপজেলায় কখনো আওয়ামী লীগ কখনো বিএনপির প্রার্থীরা জয়ের প্রধান্য অব্যাহত রেখেছেন। এছাড়া জেলার রাজনীতি যেহেতু এই শহর থেকে পরিচালিত হয় যার কারণে যশোর সদর আসনের নিয়ন্ত্রণ সব দলই নিতে চাই। এই শহরে যুব ও ছাত্র নেতাদের একটি বড় অংশের অবস্থান। ফলে এখান থেকে জেলার আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্ব বা নির্দেশনা আবর্তিত হয়। এসব কারণে যশোর সদর আসনটি দুই দলের কাছেই খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে বিএনপি অন্যতম নীতি নির্ধারক তরিকুল ইসলাম যশোর তথা গোটা দক্ষিাণাঞ্চলের বিএনপির কাণ্ডারী বলে খ্যাত। তিনি বরাবরই এই আসনে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী হন। আগামী নির্বাচনেও তিনি এই আসনে দলের একক প্রার্থী। তবে বর্তমানে তরিকুলের শারীরিক অবস্থা ভাল যাচ্ছে না। এ অবস্থায় নির্বাচনকালীন সময়ে কতটুকু প্রচারণা চালাতে পারবেন তা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। তবে অনেকেই বলেন, তরিকুল শুধুমাত্র ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বাড়ি বসে থাকলেও তার কর্মী সমর্থক ও ভক্তরা ভোট চালিয়ে নিতে পারবেন। আবার কেউ কেউ বলছেন শেষ পর্যন্ত তরিকুল নির্বাচন করতে সক্ষম না হন তাহলে তার সহধর্মিণী বিশিষ্ট রাজনীতিক অধ্যাপিকা নার্গিস বেগম প্রার্থী হবেন।
অধ্যাপক নার্গিস বেগমের রয়েছে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা। ছাত্রজীবন থেকে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোর নেত্রী হিসেবে তিনি বহু আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিগত বছরগুলোতে তিনি জেলা বিএনপির নির্বাহী সদস্য হিসেবে সরকার বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে লড়াই সংগ্রাম করেছেন। তিনি জেল জুলুম হুলিয়া মাথায় নিয়ে নেতাকর্মীদের সাথে রাজপথে সরব থেকেছেন সব সময়। তরিকুল ইসলামের অসুস্থতাজনিত সাময়িক অনুপস্থিতির সময়ে তিনিই দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বর্তমানে তিনি জেলা বিএনপির সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অধ্যাপিকা নার্গিস ইসলাম প্রার্থী হতে না চাইলে বিএনপি নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সহ সাংগঠনিক সম্পাদক তরিকুল পুত্র অনিন্দ্য ইসলাম অমিতকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান। ইতিমধ্যে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও পরিশ্রম দিয়ে রাজনীতির মাঠে নিজেকে যোগ্য হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা এখন পিতা তরিকুল ইসলামের মতোই পুত্র অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের ওপর ভরসা রাখতে পারেন বলে মন্তব্য করেছেন তার অনুসারীরা।
অবশ্য জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, আগামী নির্বাচনে যশোর-৩ আসনে তরিকুল ইসলাম তাদের প্রার্থী। তবে যদি কোনো কারণে তরিকুল ইসলাম স্বেচ্ছায় নির্বাচন না করেন সেই ক্ষেত্রে তিনি মনে করেন তরিকুল ইসলাম তাকে এই আসনে প্রার্থী হতে আদেশ করবেন। সৈয়দ সাবু বলেন, তরিকুল ইসলাম তার রাজনৈতিক অভিভাবক। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিরামহীন ভাবে তিনি তরিকুল ইসলামের নৈকট্যে থেকে রাজনীতি করছেন। অতীতে সব সময় তিনি তরিকুল ইসলামের সহানুভূতি লাভ করেছেন। আগামীতেও তা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে নির্বাচন প্রশ্নে সৈয়দ সাবেরুল হক সাবুর মন্তব্য কিছুটা ভিন্ন। তিনি মনে করেন, আওয়ামী লীগের ডিকসোনারিতে ফ্রি এন্ড ফেয়ার ইলেকশন শব্দটি নেই। আওয়ামী লীগ ফ্রি এন্ড ফেয়ার ইলেকশন বোঝে না। অতীতেও কখনো ফ্রি এন্ড ফেয়ার ইলেকশন দেয়নি। ভবিষ্যতেও দেবে না। তারা জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার হরণ করে জোরপূর্বক ক্ষমতায় থাকতে চায়। তার জন্য তারা আগামী নির্বাচনকে একটি প্রহসনের নির্বাচনে পরিণত করতে চায়। শেখ হাসিনার অধীনে কোনো পাতানো নির্বাচনে বিএনপি অংশ গ্রহণ করবে কিনা তা নিয়ে এখনো সন্দেহ আছে। তারপরও দলের চেয়ারপার্সন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্তই শেষ কথা। তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান যশোর সদর আসনে যাকে মনোনয়ন দিবেন তিনিসহ তার দলের সকল নেতাকর্মী তাকে বিজয়ী করতে জীবন বাজি রেখে কাজ করবেন।
যশোর নগর বিএনপির সভাপতি যশোর পৌরসভার সাবেক মেয়র মারুফুল ইসলাম মারুফও এই আসনের দাবিদার। তবে তরিকুল ইসলাম যদি নিজে নির্বাচন করতে না চান সেই ক্ষেত্রে। মারুফুল ইসলাম মারুফ বলেন, তিনিও তার চাচা তরিকুল ইসলামে দোয়া ও আশীর্বাদ নিয়ে রাজনীতিতে আছেন। তার আশীর্বাদ নিয়ে তিনি গত নির্বাচনে বিপুল ভোটে যশোর পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিগত আন্দোলন সংগ্রামে তিনি সাধ্য মতো রাজপথে থেকে লড়াই সংগ্রাম করেছেন। জেল জুলুম হুলিয়া মাথায় নিয়ে কখনো কর্মীদের ছেড়ে যাননি। বহুবার কারাবরণ করেছেন। কিন্তু আপোষ করেননি। এই কারণে তিনি চাচার উত্তরাধিকারী হিসেবে এই আসনে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন।
এদিকে, আগামী নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে এমন প্রত্যাশা নিয়ে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠ প্রস্তুতের জন্য কাজ শুরু করেছেন। বিশেষ করে বর্তমান এমপি কাজী নাবিল আহম্মেদ ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন চাকলাদার ও তাদের অনুসারীরা নির্বাচনী মাঠ নিজেদের দখলে রাখার সব রকমের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন। মাঠ পর্যায়ের কর্মীরাও এই দুই নেতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় কাজ শুরু করেছেন। এই দুই নেতা বাদেও আরো ৪-৫ জন নেতা দলীয় মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রে লবিং গ্রুপিং শুরু করেছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় পোষ্টারিং, লিফলেট বিতরণ, ফেস্টুন ও ব্যানার ঝুলিয়ে নিজেদের আগমন জানান দিচ্ছেন। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসএস