যশোর থেকে : আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার ক্রিস হোগল ও বাঙালি নারী রহিমা খাতুন প্রেমের প্রায় একযুগ পার করে ঘর বেঁধেছেন কেশবপুরের মেহেরপুর গ্রামে। মুন্সি মেহেরুল্লার মাজারের পাশে তারা বাস করছেন। ক্রিস গেইল নিজেকে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন পুরোপুরি। কৃষি কাজ করেন পরম মমতা নিয়ে।
নিজেই জমিতে ধান কাটেন, বোঝা টেনে নিয়ে ধান তোলেন ভ্যানে। এই কায়িক শ্রমে মার্কিন ইঞ্জিনিয়ারকে ক্লান্ত মনে হলো না। শনিবার সরেজমিনে কপোতাক্ষ নদের তীরে মেহেরপুর গ্রামে বিশাল বট গাছের কাছে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে রয়েছে মুন্সি মেহেরুল্লার মাজার। বটের ছায়ায় দাঁড়িয়ে গল্প শুনছিলাম সেখানে আগে থেকে বসে থাকা স্থানীয় আশরাদ আলি মোড়লের কাছ থেকে। তাকে এলাকার সবাই 'মোড়ল' নামে জানে।
মোড়লের সঙ্গে কথা বলার সময় আমাদের পেছন থেকে এসে আধো উচ্চারণে সালাম দিলেন এক ব্যক্তি। ফিরে দেখি তিনি একজন বিদেশি শেতাঙ্গ। শরীরে ট্যাটু আঁকা মানুষটি নিজে থেকে বললেন 'তার নাম মো. আয়ূব।' তাকে ইরেজিতে প্রশ্ন করলে তিনি নাম বলেন, ক্রিস হোগল। এর পর ত্রস্ত পায়ে তিনি নদীর তীরের দিকে গেলেন।
বিবেক শিল্পী মোড়ল বললেন, বিদেশি মানুষটি এখানে বিয়ে করে অনেকদিন ধরে বসবাস করছেন। প্রায় ১০-১২ বিঘা ফসলি জমি ক্রয় করেছেন। ক্রিস হোগল ধান ক্ষেত থেকে ধান এনে ভ্যানে ওঠাচ্ছেন। তিনি ধানভর্তি ভ্যান ঠেলে নিজের বাড়ির দিকে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর যখন তিনি আবার ফিরে আসেন তখন আমি ও মোড়ল ক্রিস হোগলের পথ আগলে দাঁড়ালাম। তিনি থামলেন এবং আমাদের সময় দিলেন। তিনি বাংলায় দু'একটি বাক্য বলতে পারেন।
বিশাল বটবৃক্ষের ছায়ায় মুন্সি মেহেরুল্লার মাজারের পাশে দাঁড়িয়ে ইংরেজিতে কথোপকথন শুরু হয়। ক্রিস হোগল জানান, তার বাড়ি যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে, পেশায় তিনি পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার। রহিমা খাতুনের সঙ্গে যখন দেখা হয় তখন তিনি ভারতের মুম্বাই শহরে থাকতেন। সেখানে তিনি অনিল আম্বানির রিলায়েন্স ন্যাচারাল রিসোর্সেস লিমিটেড কোম্পানিতে পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার পদে কর্মরত ছিলেন। মুম্বাই শহরেই ঘটনাক্রমে রহিমার সঙ্গে তার দেখা হয়।
রহিমা খাতুন জানান তার জীবনের কাহিনী। তিনি বলেন, শৈশবে তার বাবা আবুল খাঁ ও মা নেছারুন নেছার হাত ধরে অভাবের তাড়নায় পাড়ি জমান ভারতে। পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতে তার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। বাবা শ্রম বিক্রি করতেন। আর রহিমা সেই শৈশবে বারাসাতের বস্তিতে একা থাকতেন। তের চৌদ্দ বছর বয়সে বাবা তাকে বিয়ে দেন। জমিও ক্রয় করেন সেখানে। রহিমা খাতুন তখন তিন সন্তানের জননী। কিন্তু অভাবের তাড়নায় তার প্রাক্তন স্বামী সেখানকার জমি বিক্রি করে দেন।
রহিমা খাতুনকে একা ফেলে তার স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে যান। রহিমা খাতুন চলে যান জীবিকার সন্ধানে মুম্বাই শহরে। শ্যামল বর্ণের রহিমা খাতুন আশ্রয় নেন পূর্ব পরিচিত এক ব্যক্তির বস্তির খুপরিতে। রহিমা খাতুন দাবি করেন, হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় মুম্বাইয়ের রাস্তায় পরিচয় হয় ক্রিস হোগলের সঙ্গে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন হোগল তার পানে। হিন্দিতে দু এক লাইন কথা বলার পর তারা আবার দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন। এভাবে ছয় মাস পর তারা বিয়ে রেজিস্ট্রি করেন।
বিয়ের তিন বছর পর কর্মসূত্রে ক্রিস হোগল স্ত্রী রহিমাকে নিয়ে চীনে যান। সেখানে পাঁচ বছর ছিলেন। এরপর তারা কেশবপুরের মেহেরপুর রহিমা খাতুনের বাবার ভিটায় ফিরে আসেন। মেহেরপুরে ফিরে আসার পর রহিমা খাতুনের বাবা আবুল খাঁ মারা যান। বাড়ির উঠানের পাশে তাকে কবর দেওয়া হয়। মোজাইক পাথর দিয়ে প্রায় ১২ লাখ টাকা খরচ করে বাবার কবর সংরক্ষণ করেন তারা।
রহিমার মা নেছারুন নেছা এখনও জীবিত। রহিমার প্রথম স্বামীর তিনটি সন্তান তাদের সঙ্গে থাকে। ক্রিস হোগলের শখ বই পড়া ও মোটর সাইকেলে দূর ভ্রমণ। বর্তমানে একটি সুন্দর পরিবার পেয়ে তারা সুখী। ক্রিস হোগল বলেন, মিশিগান খুব সুন্দর শহর। আমেরিকান স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় অনেক আগে। সেখানে তার মা ও ছেলে মেয়ে রয়েছেন। মেহেরপুরে বাড়ির কাজ শেষ হলে আমেরিকা থেকে মা ও ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আসবেন এখানে।
বহুদেশ ঘুরেছেন ক্রিস। তবে বাংলার সবুজ প্রকৃতি, ধান ক্ষেত ও সরিষা ফুলের হলুদ রং তাকে বিমোহিত করে বারংবার। এই দেশে অনেক ভালো মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে। ৪ বছর একটানা মেহেরপুরে আছেন। বাকি জীবনও এখানে কাটাতে চান বাংলার প্রকৃতিকে ভালোবেসে। এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য পোশাক কারখানা করাসহ আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার কাজ করতে চান।