বুধবার, ৩০ মার্চ, ২০১৬, ০৪:২৭:৪১

মাঠ 'ছেড়ে' দিয়েছে বিএনপি

মাঠ 'ছেড়ে' দিয়েছে বিএনপি

রাজীব নূর ও তৌহিদুর রহমান : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যশোরের মনিরামপুর হয়ে উঠেছিল সহিংস। একের পর এক বোমা হামলা হয়েছে তখন। ঘটেছে অগি্নসংযোগের ঘটনা। হতাহতের সংখ্যা ছিল শতাধিক। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন ভোট বর্জনকারী জামায়াত-বিএনপির কেন্দ্র দখল, ভাংচুর ও তা বে বিস্মিত হয়েছিল সারাদেশ।

নির্বাচনের আগে থেকে শুরু হওয়া ওই তাপে মনিরামপুরের দিকে ছিল দেশবাসীর বিশেষ নজর। ২২ মার্চ মনিরামপুরের ১৬টি ইউনিয়নে রক্তপাতহীন নির্বাচন হয়ে যাওয়ায় ধারণা জন্মেছিল আগামীকাল বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় ধাপে যশোর সদর উপজেলায়ও নির্বাচন হবে শান্তিপূর্ণ। কিন্তু সদর উপজেলার যে ১৫ ইউনিয়নে কাল নির্বাচন হচ্ছে, তার কয়েকটিতে সরেজমিন ঘুরে ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক লক্ষ্য করা গেছে। এরই মধ্যে তিনটি ইউনিয়নে বিএনপি মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিতে 'বাধ্য' হয়েছেন। অন্য ইউনিয়নগুলোতে প্রার্থী থাকলেও নির্বাচনের মাঠ ছেড়ে দিয়েছে বিএনপি।

নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা হচ্ছে সপ্তাহখানেক আগে থেকেই। আওয়ামী লীগের মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীদের নির্বাচনী কার্যালয়ে এ পর্যন্ত সাতটি বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগ এ সব বোমা হামলার জন্য বিএনপিকে দায়ী করে মামলাও করেছে। কিন্তু বিএনপির দাবি, এখনও যে ১২টি ইউনিয়নে বিএনপির প্রার্থী রয়েছেন, তাদের কাবু করতেই সাজানো হয়েছে এ সব বোমা হামলার নাটক। বিএনপির বক্তব্য, 'আওয়ামী লীগ আমার ভোট আমি দেব, তোমার ভোটও আমি দেব' নীতি নিয়ে এগোচ্ছে।

প্রত্যাহারের দিন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন আরবপুর ইউনিয়নের বিএনপি মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম। তিনি এখনও ওই ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। পর পর দু'বার নির্বাচিত ওই চেয়ারম্যান ইউনিয়ন বিএনপিরও সভাপতি। অন্য দুটি ইউনিয়নের মধ্যে নরেন্দ্রপুরে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুস সালাম বিশ্বাস ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা আমিনুর রহমান এবং দেয়াড়া ইউনিয়নে বিএনপির এনামুল হক চঞ্চল মনোনয়নপত্র জমা দিয়েও প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।

মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেওয়া এই চেয়ারম্যান প্রার্থীদের কেউই মুখ খুলতে রাজি হচ্ছেন না। 'ব্যক্তিগত কারণে'র কথা বলে তারা প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছেন। অবশ্য জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, 'ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়িয়ে নির্বাচন থেকে নিজেদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়েছে বিএনপির ওই তিন প্রার্থীকে।'

ওই প্রার্থীরা তাকে কিছু জানিয়েছেন কি-না জিজ্ঞেস করা হলে সৈয়দ সাবেরুল বলেন, 'যে ভয়ে নিশ্চিত বিজয়ী হতে পারার মতো নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন, সেই ভয়ের কথা জানিয়ে কি আরও বিপদ ডেকে আনবেন তারা?' নির্বাচনে দাঁড়িয়ে থাকলে এবং ভোটাররা ভোটাধিকার প্রয়োগের ন্যূনতম সুযোগ পেলে এই তিনজনের বিজয় কেউ ছিনিয়ে নিতে পারত না। তিনি বলেন, যশোরের ১৫টি ইউনিয়নের ১২টিতে এখনও বিএনপির নেতারাই চেয়ারম্যান। একটিতে জামায়াতে ইসলামী। দুটি ইউনিয়নে বিজয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ। তিনি বলেন, 'আওয়ামী লীগের মাস্তানরা মাঠে নেমেছে।'

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন চাকলাদার অবশ্য বিএনপির এ সব অভিযোগ অমূলক বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, 'নিজেদের নিশ্চিত পরাজয় জেনে বিএনপি ৫ জানুয়ারিতে নির্বাচন বর্জন করে যে নাটক করেছিল, তার মতোই একটা নাটক সাজাচ্ছে। এবার কেউ প্রার্থী থাকছে, আবার কেউ প্রত্যাহার করছে, এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা নিজ দলের ইজ্জত রক্ষা এবং আওয়ামী লীগকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে।'

সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ বলেন, 'বিএনপির কাউকে ভয় দেখিয়ে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। আসলে যাদের সাহসের ঘাটতি রয়েছে, যারা বিগত দিনে চেয়ারম্যান হয়েও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন, তারাই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।'

আলোচিত এই তিন ইউনিয়নের মধ্যে আরবপুরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাহারুল ইসলাম, নরেন্দ্রপুরে উপজেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক মোদাচ্ছের আলী ও দেয়াড়ায় ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আনিসুর রহমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ওই তিনজন আবার যশোরে আওয়ামী লীগের পরস্পরবিরোধী দুই বলয়ের প্রতিনিধি। অবশ্য যশোর আওয়ামী লীগে একদা বলয় ছিল আরও বেশি।

সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনের পর কিছু বলয়ের বিলুপ্তি ঘটলেও নতুন করে দুটি বলয়ের জন্ম হয়েছে, এর একটির নেতৃত্বে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার, অন্যটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন সদরের সাংসদ কাজী নাবিল আহমেদ। তবে কাজী নাবিলের অনুপস্থিতিতে এখানে তার বলয় পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের জেলা শাখার সভাপতি শহীদুল ইসলাম মিলন ও সদর উপজেলা শাখার সভাপতি মোহিত কুমার নাথ। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে দু'পক্ষের ঐক্য এখন দৃষ্টিগ্রাহ্য। প্রতিদিনই একমঞ্চে উপস্থিত হচ্ছেন শাহীন চাকলাদার, শহীদুল ইসলাম মিলন ও মোহিত কুমার নাথ।

এই ঐক্যের নেপথ্যের কারণ জানতে চাওয়া হলে মোহিত কুমার নাথ বলেন, 'নৌকা প্রতীকই তো আমাদের ঐক্যের নিয়ামক। বিরোধ আছে, হয়তো থাকবেও। বড় দলে বিরোধ থাকেই। তবে দলের বৃহত্তর স্বার্থে আমরা এক।' শাহীন চাকলাদারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ হাসান বিপুও অভিন্ন বক্তব্য দেন। তবে তিনি বলেন, 'এ নিয়ে ঢাকায় আওয়ামী লীগের খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হকের মধ্যস্থতায় একটি সমঝোতা বৈঠক হয়।'

এ নেতাদের কেউ স্বীকার না করলেও চেয়ারম্যান প্রার্থীদের পরিচয় থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দু'পক্ষের মধ্যে চেয়ারম্যান প্রার্থীও ভাগাভাগি হয়েছে। তবে এই ভাগাভাগিতেও শেষ রক্ষা হয়নি। যশোর শহরের উপকণ্ঠের ইউনিয়ন চাঁচড়ায় আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল আজিজ বিশ্বাস বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে লড়ছেন। এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন মোহিত কুমার নাথের ঘনিষ্ঠজন আনোয়ারুল করিম আনু। বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা। যশোরের এই একটি ইউনিয়নেই নির্বাচনী উত্তাপ দেখা গেল।

গতকাল দুপুরে কথা হলো চাঁচড়া ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদ্য বরখাস্ত হওয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি আতিয়ার রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তৃণমূলের ইচ্ছার প্রতিফলন না ঘটায় তারা আজিজ বিশ্বাসকে নিয়ে মাঠে নেমেছেন। ফলে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। সর্বশেষ ২৭ মার্চ বিনোদের মোড়ে তাদের নির্বাচনী কার্যালয় ভাংচুর ও বোমা হামলা করা হয়। তিনি বলেন, তারা চান অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। সুষ্ঠু নির্বাচনে যিনি বিজয়ী হবেন, তারা তার পক্ষেই থাকবেন।
৩০ মার্চ, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে