জামিউল আহসান সিপু ও আহমেদ সাঈদ বুলবুল: ‘আমাদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন বাঁওড় কেড়ে নিয়েছে। আমরা কোথায় মাছ ধরব? বাপ-দাদার পেশা টিকিয়ে রাখব কিভাবে? ওরা এখনও মহড়া দেয়, বলেছে তাদের পক্ষে ভোট না দিলে আমাদের কেটে ভৈরব নদে ভাসিয়ে দেয়া হবে। এখানে আমরা থাকতাম না। আমরা ভারতে চলে যেতাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন বলেই আমরা এখানে আছি। আগের হামলাকারীরাই আমাদের আবার ভয় দেখাচ্ছে। এভাবেই বলছিলেন যশোরের অভয়নগর উপজেলার সেই আলোচিত চাঁপাতলার মালোপাড়ার জেলে পরিবারের সদস্য বিশ্বজিত্ সরকার।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন মালোপাড়ায় বীভত্স হামলার শিকার হয় ১৫১টি জেলে পরিবার। হামলার প্রথম শিকার হন বিশ্বজিত্ সরকার। শরীরে এখনও তার দগদগে ক্ষত। আগামী ২৮ মে এখানকার স্থানীয় প্রেমবাগ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের পক্ষে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে সর্দার বাবুল আক্তারকে। এই বাবুল আক্তারের ছোট ভাই আনোয়ার সর্দার ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকালে মালোপাড়ায় হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তারা মালোপাড়ায় হামলা চালিয়ে ১৫১টি জেলে পরিবারে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল।
আসন্ন ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মালোপাড়ায় জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে ফের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। জেলে সম্প্রদায়ের পুরুষ ও নারীরা বলেছেন, এবারের নির্বাচনে হয়তো তাদের ভোট দেয়া হবে না। কারণ তারা হামলাকারীর সমর্থকদের ভোট দিতে চান না। তাদের মনে শঙ্কা, ভোট কেন্দ্রে গেলে তাদের ওপর ফের হামলা চালানো হতে পারে।
যশোর সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের মালোপাড়ায় ২শ বছর ধরে এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিবারগুলো বসবাস করে আসছে। প্রায় ১শ একর জমি জুড়ে থাকা সরকারি একটি বাঁওড়ই এই পরিবারগুলোর জীবিকা প্রধান অবলম্বন। ১৯৭২ সাল থেকে বাহিরঘাট মত্স্যজীবী সমবায় সমিতির নামে তারা এই বাঁওড়ে মাছ ধরে আসছে। গত মাসে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা প্রেমবাগ সমবায় সমিতি নামে একটি সমিতি গঠন করে এই বাঁওড় লিজ নিয়েছে। ফলে মালোপাড়ার জেলেরা প্রায় এক মাস ধরে এখানে মাছ ধরতে পারছে না।
পৈতৃক পেশা বন্ধ হওয়ায় এখন কি করবেন—এমন প্রশ্নের জবাবে মালোপাড়ার সুশান্ত বিশ্বাস বলেন, ‘আমার একটা ছোট নৌকা আছে। বাঁওড়ে আমরা যেতে পারছি না। এখন বিকল্প বলতে ভৈরব নদ। কিন্তু সেখানে তেমন মাছ নেই। এমতাবস্থায় বউ-ছেলে নিয়ে দেশান্তরি হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন তিনি। বললেন, ‘ওরা এখন মহড়া দেয়। শুনেছি মামলার আসামি হওয়ার পর পুলিশের কাছে টাকা দিয়ে চার্জশিট থেকে নাম বাদ দিয়েছে। ওরা জেল থেকে বেরিয়ে এখন চেয়ারম্যান প্রার্থী বাবুল সর্দারের পক্ষে ভোট চাইছে। আমরা ভোট দিব কিনা জানি না। ভোট যদি না দেই তাহলে তো বাপ-দাদার ভিটিমাটি ছাড়তি হবি।’
মালোপাড়ার শ্যামল বিশ্বাস বলেন, “আমরা বাঁওড়ের লিজ পাওয়ার জন্য এমপি সাহেবের (রনজিত্ রায়) পা ধরেছিলাম। বলেছিলাম, দাদা আমাদের ফেলে দিয়েন না। আমরা আওয়ামী লীগ করি। এটাই কি আমাদের পাপ। আমরা কি বাপ-দাদার পৈতৃক পেশায় থাকতে পারব না? এমপি সাহেব পা ছাড়িয়ে নিয়ে বলেন, ‘আমার করার কিছুই নাই’।
এ ব্যাপারে প্রেমবাগ মত্স্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আজিজার রহমান বলেন, ‘৩১ জনের এই সমিতি। আমরা সবাই বাঁওড়ের পাশে থাকি। সেই হিসাবে আমরা মত্স্যজীবী কোটায় এই লিজ পেয়েছি।’ তবে তারা কেউই জেলে নন বলে জানা গেছে।
মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে যশোর-৪ (অভয়নগর-বাঘারপাড়া) আসনের সংসদ সদস্য রণজিত্ রায় বলেন, ‘অমত্স্যজীবী একটি গ্রুপ বাঁওড়ের মাছ লুটপাট করছে। বিষয়টি আমি জানি। বিষয়টি সমাধানের জন্য আমি জেলা প্রশাসককে বলেছি।’ তিনি বলেন, ‘মালোপাড়ায় জেলে সম্প্রদায়ের আতঙ্কের বিষয়টি আমি জানি। রবিবার আমি মালোপাড়া পরিদর্শন করেছি।’ অবশ্য স্থানীয় জেলেরা অভিযোগ করে বলেন, গত এক বছরে একবারও তিনি এলাকায় আসেননি। সংসদ সদস্য তাদের কোনো খোঁজ নেন না।
মালোপাড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলেদের জন্য ৪৫টি পাকা ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এছাড়া যেসব বাড়ি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো মেরামত করে দেয়া হয়েছে। যাদের জাল পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, তাদেরকে আবার জাল কিনে দেয়া হয়েছে। পাকা বাড়ির পাশেই খোলা জায়গায় ওইসব জাল রোদে শুকাতে দেয়া হয়েছে।
পাকা বাড়িতে জেলে সম্প্রদায় বসবাস করতে পেরে প্রধানমন্ত্রীর ওপর খুব খুশি। কিন্তু এই ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। আবারও কী হামলা হবে মালোপাড়ায়-এমন প্রশ্নের জবাবে বিথীকা রানী বলেন, ‘আমাদের এখানে ৪২০ জন ভোটার আছেন। আমরা যদি ভোট না দিই, তাতে সরকারের কি বা আসে যায়? এখন হামলাকারীরা আওয়ামী লীগ সেজে গেছে। তাদের লোকজন এখন মালোপাড়ায় ঘুরে বেড়ায়।’
ওই দিনের হামলায় আহত শ্যামল বিশ্বাস বলেন, ‘ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভক্তি এসেছে। যাকে (সর্দার বাবুল) চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে সে যদি নির্বাচনে জিতে তাহলে আমাদের আর মালোপাড়ায় থাকতে দিবে না। পৈতৃক ভিটে থেকে উচ্ছেদ করবে।
যশোর জেলা প্রশাসক ড. হুমায়ুন কবীর বলেন, বাহিরঘাট মত্স্যজীবী সমবায় সমিতির নামে যে দরপত্র দেয়া হয়েছিল সেখানে সরকারের রাজস্ব অনেক কম উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি দেখে আমি নিজে মালোপাড়ার জেলে সম্প্রদায়কে ডেকে বলি যে, তোমরা লিজের মূল্য একটু বাড়িয়ে দাও। কারণ সরকারের বাঁওড়ের মাছ ধরার লিজ নীতিমালায় যে বেশি রাজস্ব দিবে তাদেরকে দেয়ার নির্দেশ রয়েছে। তারা বিষয়টি মানতে রাজি হয়নি। এরপরও তাদেরকে আমি প্রেমবাগ মত্স্যজীবী সমবায় সমিতির সঙ্গে মিলে মিশে মাছ ধরতে বলেছি। তাদের সকল নিরাপত্তা আমি দেখব।
যশোর পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি অসীম কুণ্ডু বলেন, প্রধানমন্ত্রী যখন সহিংসতা বন্ধের কথা বলছেন, ঠিক সেই সময় হামলাকারীদের একজনকে ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়ায় আমরা হতবাক। মালো সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হোক, এমন কাজ কেউ করবেন না বলে আমরা সকলকে অনুরোধ করছি।
মালোপাড়া পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই বেলায়েত হোসেন বলেন, মালোপাড়ার নিরাপত্তায় ৮ পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। এখন পর্যন্ত কোনো হুমকির অভিযোগ তিনি পাননি।
যশোর পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান বলেন, মালোপাড়ার সার্বিক নিরাপত্তা দেখার জন্য পুলিশ ক্যাম্প রয়েছে। সেখানে ২৪ ঘণ্টা ডিউটি পালন করা হচ্ছে। কেউ হুমকি দিয়েছে বা হামলা হতে পারে-এমন অভিযোগ কেউ করেনি।-ইত্তেফাক
৩ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ