তৌহিদ- উজ- জামান, যশোর : পোস্টারে জঙ্গি তালিকার শীর্ষে নিজের নাম ও ছবি দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন কামরুজ্জামান তুহিন ওরফে মুন্না। সোমবার ভোরে তিনি নতুন বৌকে নিয়ে বাড়ি ফিরে জানান, মায়ের ওপর রাগ করে বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় গিয়েছিলেন। তবে যশোর পুলিশ তাকে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত বলে দাবি করছে।
সোমবার ভোরে বাবার সঙ্গে স্ত্রী ও শ্বশুরপক্ষের তিন আত্মীয়সহ তিনি শহরের শংকরপুরের বাসায় ফেরেন।
এরমধ্যে যশোর পুলিশ জঙ্গি হিসাবে দাবি করে যে পাঁচজনের নাম ও ছবি দিয়ে পোস্টার করেছে, তার মধ্যে মুন্নার নাম রয়েছে সবার আগে। কামরুজ্জামান তুহিন ওরফে মুন্না যশোর শহরের শংকরপুর গোলপাতা মসজিদ এলাকার চা-দোকানি আবদুস সোবহানের ছেলে। বছর তিনেক আগে তিনি বাড়ি ছাড়েন।
যশোরে ফিরে মুন্না সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, তিনি জঙ্গি নন। যশোরে এসে জানতে পারেন পুলিশ তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য নাম-ছবিসহ পোস্টার ছেপেছে। যশোর পুলিশের ছাপানো জঙ্গি তালিকা সম্বলিত পোস্টারে নিজের নাম ও ছবি দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন মুন্না।
বাড়ি ছাড়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘মায়ের ওপর রাগ করে বাড়ি ছাড়ি। ঢাকায় ছিলাম বছর তিনেক। প্রথমে ডেকোরেটরের দোকানে, পরে প্লাস্টিক কারখানায় কাজ নিয়েছি। কাজ করে খাই। বিয়েও করেছি। কোনও ধরনের জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে আমি জড়িত নই।’
তার বাবা সোবহানের দাবি, মায়ের বকুনি খেয়ে মুন্না বাড়ি ছাড়ে। দেশে জঙ্গি তৎপরতা শুরু হলে স্থানীয় কাউন্সিলর গোলাম মোস্তফা তাকে থানায় নিয়ে যান ছেলে নিখোঁজের ব্যাপারে সাধারণ ডায়েরি করতে। (যশোর কোতোয়ালি থানা ডায়রি নম্বর ৩৭৮/ ১০.০৭.২০১৬ । এর পর কোতোয়ালি থানার এক দারোগা এলাকায় তদন্তে আসেন। তিনি এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হন মুন্না জঙ্গি না। কিন্তু সরকার দলীয় প্রভাবশালী এক ব্যক্তির কথা মতো থানার এক কর্মকর্তা তাকে জঙ্গি হিসাবে সাব্যস্ত করেন। এরপর তার ছেলেকে জঙ্গি বলতে শুরু করে পুলিশ।
মুন্না বলেন, বছর তিনেক আগে মায়ের সঙ্গে রাগারাগি করে বাসা ছেড়ে ঢাকায় চলে যাই। সেখানে ইসলামবাগ এসি মসজিদ গলির জনৈক ডিশ মাহমুদের প্লাস্টিক কারখানায় বছর দুয়েক কাজ করেছি। পরে জিঞ্জিরা খেজুরবাগ বালুরচর এলাকায় রফিকের ডেকোরেটরের দোকানে কাজ নেই। সেখানে বাংলাবাজারের বই সাপ্লায়ার মনির খানের মেয়ে ইয়াসমিন আক্তারের সঙ্গে আলাপ হয়। প্রথমে আমাদের মধ্যে প্রেম, পরে মাস ছয়েক আগে অনানুষ্ঠানিক বিয়ে হয়। বাবা (শনিবার)আমার খোঁজে ঢাকা আসলে আমাদের আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়। সোমবার স্ত্রী ইয়াসমিন, এক শ্যালিকা ও দুই নানি-শ্বাশুড়িকে নিয়ে আমি যশোর ফিরেছি।’
সোবহান শহরের শংকরপুর গোলপাতা মসজিদ এলাকার জনৈক মুরাদ হাজির বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে সপরিবারে বসবাস করেন। তারা শরীয়তপুর জেলার বাসিন্দা।বাবার কর্মসূত্রে যশোর আসেন সোবহান। তিনি ভাঙাড়ির কারবার থেকে শুরু করে রিকশা চালানো পর্যন্ত সবই করেছেন। শারীরিক সমস্যার কারণে এখন আর ভারী কাজ করতে পারেন না। তাই এলাকায় একটি চায়ের দোকান দিয়ে বসেছেন। চার ছেলে-মেয়ের জনক সোবহান। মেয়ে দুটিকে বিয়ে দিয়েছেন। আর ছেলে দুটি নিজেদের চেষ্টায় যতটুকু সম্ভব লেখাপড়া করেছে। বড় ছেলে মুন্না ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ডিগ্রি ভর্তি হয়ে আর পড়েননি। মুন্না তার মামার ভাঙাড়ির দোকানে কাজ করে লেখাপড়া চালিয়েছেন। পরে পড়াশুনা বাদ দিয়ে ইজিবাইক চালাতেন। আর ছোট ছেলে আবদুল আহাদ যশোর এমএম কলেজে বিএ ফার্স্ট ইয়ারে পড়েন। তিনি কোচিং চালিয়ে লেখাপড়ার খরচ যোগান।
আবদুস সোবহান জানান, প্রায় তিন বছর আগে ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগের (আইপিএল) জুয়া শুরু করে স্থানীয় একটি চক্র। এর হোতা গোলপাতা মসজিদ এলাকার এরশাদের ছেলে কলিম। গরিবের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও মুন্না ওই জুয়ায় জড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে মা কমলার বকুনি খেয়ে এক কাপড়ে ঘর ছাড়েন মুন্না। তখন থেকে তার সঙ্গে পরিবারের কোনও যোগাযোগ ছিল না।
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে দেশদ্রোহী হলে তার সাজা হোক। কিন্তু বিনা দোষে যেন শাস্তি না পায়।’ এক প্রশ্নের জবাবে সোবহান বলেন, ‘মুন্না ধর্ম কর্ম খুব একটা করতো না। শুক্রবারের দিন বকাঝকা করে তাকে জুমার নামাজ পড়তে নিয়ে যেতাম।’
সোমবার সকালে সোবহানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ভিড় জমছে। অনেকে তাদের চির চেনা মুন্নাকে দেখতে আসছেন। আবার অনেকে ‘জঙ্গির খাতায় নাম ওঠা নতুন মুন্না কেমন তা দেখতে আসছে।’
মা কমলা দীর্ঘদিন পর ছেলেকে কাছে পেয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছেন। আর বাবা আবদুস সোবহান এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তাদের নিয়ে তিনি পুলিশ সুপারের কাছে যাবেন।
এলাকার একটি সূত্র জানায়, ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের অবস্থান কর্মসূচির সময় মুন্না পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। পরে তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন।তার পরিবারও বিষয়টি জানে না বলে তাদের দাবি। অবশ্য এ তথ্যের স্বপক্ষে কোনও তথ্য-প্রমাণ যোগাড় করা যায়নি।
প্রসঙ্গত, গত ২১ জুলাই যশোর পুলিশ জানিয়েছিল যশোরে ১১৪ জন নিখোঁজ। যাদের প্রায় সবার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় জিডিই করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫ জন বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত।
জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত যে পাঁচজনের তালিকা পুলিশের কাছে রয়েছে তারা হলেন- যশোর শহরের শংকরপুর গোলপাতা মসজিদ এলাকার আব্দুস সোবহানের ছেলে কামরুজ্জামান তুহিন ওরফে মুন্না (২৪), যশোর সদরের কিসমত নওয়াপাড়া এলাকার কাজী হাবিবুল্লাহর ছেলে ফজলে রাব্বী (২১), শার্শা উপজেলার শ্যামলাগাছি এলাকার আওরঙ্গজেবের ছেলে মেহেদি হাসান জিম (১৯), মণিরামপুর উপজেলার দুর্গাপুর এলাকার হাসান আলী গাজীর ছেলে জিএম নাজিমউদ্দিন ওরফে নকশা নাজিম (৪২) এবং যশোর শহরের ধর্মতলা এলাকার আব্দুস সালামের ছেলে রায়হান (২১)। - বাংলা ট্রিবিউন
২৫ জুলাই, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম