সোমবার, ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১০:০২:৪৪

‘ছেলে গেছে ভিটেমাটিও গেছে, কবরের জমিও দালালের পেটে’

‘ছেলে গেছে ভিটেমাটিও গেছে, কবরের জমিও দালালের পেটে’

রোকনুজ্জামান পিয়াস ও আমিনুল ইসলাম লিটন : ছেলে আর ছেলে থুইনি। কারেন্টের হিট দিয়েছে। তার মাথায় রক্ত জমে গেছে। এই এক ছেলে ছাড়া দুনিয়ায় আমার আর কেউ নেই। ছেলের জন্য পাগল হয়ে গেছি। কথাগুলো বলতে গিয়ে বারবার হাঁউমাউ করে কেঁদে ওঠেন ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু থানার রঘুনাথপুর ইউনিয়নের সড়াবাড়িয়া গ্রামের রাজিয়া বেগম। হাশেম তার একমাত্র সন্তান। তার বাবা গ্রামের ভূমিহীন দিনমজুর। ভিটের একখণ্ড জমি ছাড়া কিছুই নেই তার। সেখানেই তুলেছেন মাটির তৈরি দুইটি খুপড়ি ঘর। সেই খুপড়িতেই বাস হাশেমের মা-বাবা, স্ত্রী ও দুই সন্তানের। কিন্তু সেই ভিটেমাটিও দালালের পেটে গেছে। এখন আর আমাদের কবরের জায়গাও নেই। আমরা মারাগেলে যে আমাদের কবর দিবে সেই সাড়ে তিন হাত জমিও আজ আমাদের নেই। গত তিনমাস আগে টেকনাফের সমুদ্রপথ দিয়ে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য ট্রলারে ওঠেন হাশেম।

এরপর দীর্ঘদিন খবর ছিল না তার। ১ মাস ২০দিন পর পরিবার খবর পায় তিনি বেঁচে আছেন। জানতে পারে- তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছে। হাশেমের ষাটোর্ধ মা বলেন, ‘দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পর ছেলে যখন কথা কইছে, তখন কইছে- মা বাঁচাও, মা বাঁচাও।’ তিনি আরও জানান, ‘এইসব কথা শুনে দালালের কাছে গেছি। দালাল অনেক টাকা চাইছে। তাই ভিটেমাটি বিক্রি করে ও গ্রামের লোকজনের কাছে হাত পেতে দালালের টাকা দিছি। কিন্তু কবে ছেলে ফেরত পাবো জানিনে।’ তিনি চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘একটা ডিম ভাজলে ছেলে আমারে ছাড়া খাইনি। সেই ছেলে আজ কি করছে, কি খাচ্ছে!

জেলা সদরের চরমুরারিদহ গ্রামের রফিকুল ইসলাম আড়াই মাস আগে একই পথে রওনা দেন মালয়েশিয়ার উদ্দেশে। কিন্তু তার পরিণতি কি হয়েছে কেউ জানে না। সহায়-সম্বলহীন এ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। অন্যের জমি বর্গা করে ভালই চলছিল তার। কিন্তু দালালের খপ্পরে পড়ে তিনিও পাড়ি জমিয়েছিল সর্বনাশা এ পথে। তাকে ফেরত পাওয়ার আশায় প্রতারকচক্রকে টাকা দিলেও আজও খোঁজ মিলেনি তার। এমনকি মেরে ফেলবে- এমন আশঙ্কা থেকে কারও সঙ্গে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছেন পরিবারের লোকজন। একমাত্র উপার্জনক্ষম এ ব্যক্তিটিকে হারিয়ে এখন দিশাহারা তারা। জেলার ৬টি উপজেলার অসংখ্য পরিবারে এ ধরনের মর্মান্তিক নানা ঘটনা রয়েছে।

সরজমিনে জেলার বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রত্যেক ইউনিয়নের কোন না, কোন গ্রাম থেকে অবৈধ সমুদ্রপথে পাড়ি জমিয়েছেন মানুষ। এর মধ্যে কয়েকজন গন্তব্যে পৌঁছালেও অধিকাংশই রয়েছে নানারকম সমস্যায়। কাজ নেই, কাটাচ্ছেন বন্দিজীবন। আর নিখোঁজ রয়েছেন দেড়শতাধিক। এ মানুষগুলোর ভাগ্যে কি ঘটেছে তা নিয়ে শঙ্কিত পরিবার। হাশেমের মা রাজিয়া বেগম জানান, পরিবারের কাউকে কিছু না বলে তার ছেলে বাড়ি থেকে বের হয়। পরদিন ফোন করে জানায়-সে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য ট্রলারে উঠছে। এরপর আর কথা হয়নি। পরে জানতে পারি পার্শ্ববর্তী চাঁদপুর গ্রামের মেরাজের মাধ্যমে সে ট্রলারে গেছে। এরপর ১ মাস ২০দিন পর কথা বলে তার ছেলে। বলে, থাইল্যান্ডের জঙ্গলে নিয়ে তাকে মারধর করেছে। ওইসময় দালাল মেরাজের কাছে গেলে মোট ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা দাবি করে। টাকা দিতে রাজি হয়ে, মারধর না করার জন্য হাশেমের পরিবার মেরাজের কাছে আকুতি জানায়। পরে দুই মেয়াদে ভিটে বিক্রি করে ১ লাখ টাকা দেয়া হয়। বর্তমান এটি অন্যের জায়গা।

এদিকে কিছুদিন পর ওই দালাল আরও টাকা দাবি করে। নির্যাতনও চলতে থাকে। নির্যাতন বন্ধ করতে মেরাজের কাছে গেলে সে ধমক দিয়ে বলে ‘পকেটমারও তো মার খায়।’ পরে গ্রামের মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা মেরাজকে দেয়া হয়। এরপর তারা জানতে পারেন হাশেম মালয়েশিয়াতে আছেন। কিন্তু কি অবস্থায় আছেন বিস্তারিত কিছু বলতে পারেনি পরিবারের লোকজন। বর্তমান পরিবারটি চলছে গ্রামের লোকজনের সহযোগিতা নিয়ে। হাশেমের দুই ছেলে। বড় ছেলে এবার জেএসসি পরিক্ষার্থী আর ছোট সন্তান ৪ বছর বয়সী। ওই গ্রামের বাসিন্দারা জানান, তাদের গ্রাম থেকে আরও ৩ জন একই দালালের মাধ্যমে এ পথে পা বাড়িয়েছে। এর মধ্যে আজাদ ও খায়রুলের পরিবার থেকে ১১ লাখ আলমের পরিবার থেকে ৪ লাখ টাকা নিয়েছে দালাল মেরাজ।

ঝিনাইদহ পৌর এলাকার চরমুরারিদহ গ্রামের রফিকুল ইসলাম ও আবুল কালাম আজাদ আড়াই মাস আগে স্থানীয় লিটু দালালের মাধ্যমে সাগরপথে রওনা দেয়। তাদের পরিবারেরও কেউ জানতো না। পরে ১ মাস ১০দিন পর ফোন করে বলে ৫০ হাজার টাকা দিতে। তাহলে তাদের ফেরত দিবে। রফিকুলের স্ত্রী বেদানা বেগম জানান, নিজের জমিজমা না থাকায় অন্যের জমি বর্গা করে তার স্বামী ২ ছেলে ও ১ মেয়েসহ ৪ জনের সংসার চালাতো। তাকে ফুসলিয়ে ওইপথে নিয়ে গিয়ে দালালরা তাদের ফোন করে প্রথমে ১ লাখ টাকা দাবি করে। পরে বলে, ৫০ হাজার টাকা দিলে কালই মা’র ছেলে মা’র বুকে ফিরিয়ে দেবে। সেই প্রতিশ্রুতি মোতাবেক উভয় ফ্যামিলি ৭৫ হাজার টাকা বিকাশ করে। কিন্তু পরে টাকা দিলে ওই নম্বরে আর যোগাযোগ করা যায়নি। নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। বেদানা বেগম আরও জানান, ঋণ করে তারা দালালের টাকা যোগাড় করেছে। তার স্বামীর আর কোন খোঁজ পাচ্ছেন না। বেদানা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, তার হাতের খাওয়া যদি ভাগ্যে থাকে তো আল্লাহ্‌ তাকে ফিরিয়ে দে্নে। রফিকুলের ছেলে রুবেল বলে, ফোন করেই তার বাবা কেঁদে ফেলে বলে আমার আব্বু, আব্বু নাকি! তারপর টাকা পাঠাতে বলেছে।

গিলাবাড়িয়া গ্রামের রশিদের স্ত্রী অঞ্জনা খাতুন জানান, দালালরা তার স্বামীকে থাইল্যান্ডে পাচার করে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছে। তবে সে এখন ওই দেশের জেলে। এছাড়া ওই গ্রামের রকি, রাকিব ও সোহাগ একই ঘটনার শিকার হয়েছেন। তারা সবাই একই গ্রামের নফর আলী দালালের মাধ্যমে গিয়েছিল। মালয়েশিয়া প্রবাসী ফারুক নফর আলীর শ্যালক। সেই হোতা হিসেবে কাজ করে।

হরিণাকুণ্ডু উপজলার চাঁদপুর গ্রামের ইমরান হোসেন একই পথে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন ২ মাস ১৪ দিন আগে। ইমরানের মা ফেরদৌস বেগম জানান, ১৪ দিন আগে তার ছেলে ফোন করে বলেছে তারা থাইল্যান্ডের জঙ্গলে আটকে রয়েছে। এরপর ১৪ দিন ওই জঙ্গলেই ঘোরাফেরা করেছে। তার ছেলে বলেছে, সে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার পেছনে ২০০০ টাকা ওষুধ খরচ হয়েছে। একটা নম্বর দিয়ে বলে তাড়াতাড়ি এইখানে বিকাশ করতে। ওই সময় সে আরও বলে আর কথা হবে না, আমাদেরকে অন্য একটি জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। এ সময় ফোনে নারী কণ্ঠ শোনা যায় বলেও ইমরানের মা জানান। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি তার। একই গ্রাম থেকে এ ধরনের পরিণতি হয়েছে তারিক ও মুদাচ্ছের নামে আরও দুই কিশোরের।

জেলার প্রায় প্রত্যেক ইউনিয়নের কোন না কোন গ্রামে এ ধরনের নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, শৈলকুপা উপজেলার উমেদপুর গ্রামের মিলন হোসেন, উমেদপুর ইউনিয়নের ব্রাহিমপুর বদর মণ্ডলের ছেলে কামরুল ও লক্ষণদিয়া গ্রামের ইবাদত এর ছেলে টিপু একই পথে মালয়েশিয়া পৌঁছালেও এখন পর্যন্ত মনিরুদ্দিন শেখের ছেলে সাবু (৩৫), মৃত আদিল মোল্যার ছেলে মতলেব ও বকুলের ছেলে তরুণের খোঁজ মিলেনি।

সদর উপজেলার গাড়ামাড়া গ্রামের লাল চান, নাজমুল হোসেন, মাসুদ রানা, আলমগীর  হোসেন, ওলিয়ার রহমান, ফরিদ হোসেন, রিপন আলী ও বাক্কার আলী মালয়েশিয়ার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হন। এরপর থেকে তাদেরও খোঁজ পাচ্ছে না পরিবার। রামচন্দ্রপুর গ্রামের জগৎ আলী, হামিদ হোসেন, সোনারদাড়ি গ্রামের শরিফুল ইসলাম, ড্যাফলবাড়িয়া গ্রামের শামসুল ও বিলাল একই ভাবে নিখোঁজ হন। গিলাবাড়ীয়া গ্রামের লিংকন, রাকিবুল ইসলাম, সোহাগ আলী, রকি হোসেন, আবদুুর রশিদ, আনারুল, আল আমিন, লিটন হোসেন থাইল্যান্ডে আটকা পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

সড়াবাড়ীয়া গ্রামের নূর মোহাম্মদের ছেলে আলমগীর হোসেন, আক্কাস মণ্ডলের ছেলে খাইরুল, শহিদ মণ্ডলের ছেলে আজাদ, আনসার শেখের ছেলে বকুল শেখ বিশাল অঙ্কের টাকা দিয়েছেন। পরিবারের সঙ্গে কথা হলেও কোথায়, কিভাবে আছেন তার নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেননি।

মহেশপুর উপজেলার যাদবপুর গ্রামের এক সন্তানের জনক নিলুকে ৬ মাস আগে যশোর জেলার ঝিকড়গাছা উপজেলার আদমপুর গ্রামের মানব পাচারকারী মনির হোসেনের সঙ্গে সাড়ে তিন লাখ টাকা চুক্তি করে সাগরপথে মালয়েশিয়া যায়। ৬ মাসের মধ্যে তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি বেঁচে নেই ভেবে আড়াই বছরের শিশুপুত্র সিফাতকে নিয়ে স্ত্রী বাবার বাড়ি চলে গেছেন। একই ভাবে দুই মাস আগে বড়বাড়ী গ্রামের সামাদ আলীর পুত্র উজ্জ্বল, মনির উদ্দিন মনু মিয়ার পুত্র মোস্তফা, সায়েদ আলীর পুত্র উজ্জ্বল ওরফে ময়না, আবদুল মজিদ এর পুত্র রাজীবকে চৌগাছা উপজেলার জগদিশপুর গ্রামের দালাল ওহেদ ৪ জনের কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা চুক্তিতে তাদেরকে যশোর হয়ে চট্টগ্রাম পরে কক্সবাজার নিয়ে যায়। বর্তমানে তাদেরও কোন খোঁজ-খবর পাওয়া যাচ্ছে না বলে তাদের স্বজনরা জানিয়েছেন। এদিকে জাগুসা গ্রামের সাইফুল ইসলামের পুত্র নূর ইসলাম, একই গ্রামের হোসেনের পুত্র শরিফুর, মফিজউদ্দিনের পুত্র মোবারক, নূর মোহাম্মদের পুত্র জোবায়েদও নিখোঁজ রয়েছে।

কালীগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নের মল্লিকপুর গ্রামের মগরেব আলী, আশিকুর রহমান, ইমাদুল হক, ফিরোজ আলী ও আক্কাস আলী নামে ৫ যুবক একই গ্রামের দেলোয়ার ৩ মাস আগে মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্য চট্টগ্রাম নিয়ে যায়। সেখানে ২য় দালাল আজিজ জাহাজে নিয়ে জড়ো করে। পরিবারের লোকজনের নিকট থেকে ৫ লাখ টাকা আদায় করে জাহাজে করে নদীপথে পাঠিয়ে দেয়। ১ মাস পর পাঠানো যুবকদের মধ্যে আক্কাস নামে যুবকটি মালয়েশিয়া পৌঁছে বাড়িতে খবর পাঠালেও বাকি ৪ জনের এখনও কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে জেলাজুড়ে দেড়শতাধিক মানুষ নিখোঁজ রয়েছে।-মানবজমিন
২ জুন, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএএস/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে