আজাদ রহমান: গুলশান হামলায় জড়িত চিহ্নিত পাঁচ জঙ্গির একজন নিবরাস ইসলাম দীর্ঘ সময় ছিলেন ঝিনাইদহ শহরে একটি জঙ্গি আস্তানায়। সেখানে আরও সাতজনের সঙ্গে নিবরাস থাকতেন ছদ্মপরিচয়ে। নিজের নাম বলেছিলেন ‘সাঈদ’। মাস চারেক আগে ঝিনাইদহ সদর থানা থেকে দুই কিলোমিটার দূরে সোনালীপাড়ায় সাবেক এক সেনাসদস্য কওছার আলীর বাড়িতে চার কক্ষের একটি ঘর ভাড়া নিয়ে সেটাকে আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে জঙ্গিরা।
কওছার আলীর স্ত্রী বিলকিস নাহার বলেন, ৬ জুলাই ভোরে র্যাবের একটি দল ওই বাড়িতে অভিযান চালিয়ে স্বামী কওছার আলী, তাঁর কলেজপড়ুয়া দুই ছেলে বিনছার আলী (২২) ও বিনজির আলী (১৯) এবং বাড়ির পাশের মসজিদের ইমাম মো. রোকনুজ্জামান ও সহকারী ইমাম সাব্বির হোসেনকে আটক করে নিয়ে যায়। এ সময় তাঁদের ঘর তল্লাশি করে তাঁর ছেলেদের একটি ল্যাপটপ ও কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক নিয়ে যায়।
গুলশান হামলায় নিহত পাঁচ জঙ্গির ছবি দেখালে বিলকিস নাহারসহ এলাকার আরও কয়েকজন নিবরাসকে শনাক্ত করেন। যাঁকে তাঁরা সাঈদ নামে চিনতেন। বিলকিস নাহার বলেন, বাড়ির পাশের দারুস সালাম জামে মসজিদের ইমাম ও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোকনুজ্জামান আনুমানিক চার মাস আগে ভাড়াটে নিয়ে আসেন।
চার কক্ষের ঘরটির ভাড়া ঠিক হয় মাসে ২ হাজার ৩০০ টাকা। ইমাম রোকনুজ্জামান তখন বলেছিলেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র থাকবেন। প্রথমে দুজন আসেন। এঁদের একজন সাঈদ (নিবরাস) আর আরেকজনের নাম বলেন মোস্তাফিজ। কিছুদিন পর আরও ছয়জন আসেন। তাঁদের কাছে মাঝে মাঝে একটি মোটরসাইকেল আসত। রমজানের শুরুতে ছয়জন বাড়ি যাওয়ার কথা বলে চলে যান। বাকি দুজন ২৮ জুন (গুলশান হামলার দুদিন আগে) চলে যান। এরপর আর ফেরেননি কেউ।
বাড়ির মালিকের স্ত্রীর দাবি, মেসে থাকা ভাড়াটেদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ছিল কম। ঢাকায় হামলার পর আশপাশের লোকমুখে শুনেছেন, তাঁদের ভাড়াটে সাঈদ জঙ্গি, টেলিভিশনে ছবি এসেছে। এরপর ঈদের আগের দিন রাতে র্যাব এসে তাঁর স্বামী, দুই ছেলেসহ চারজনকে ধরে নিয়ে যায়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সদ্য যোগ দেওয়া ঝিনাইদহ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হরেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, চারজনকে আটক এবং এই জঙ্গি আস্তানা সম্পর্কে পুলিশের কাছে কোনো তথ্য নেই। এ বিষয়ে ঢাকায় র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ রকম কেউ র্যাবের হেফাজতে নেই। র্যাব কাউকে ধরলে আইনের বাধ্যবাধকতা মেনে যথাসময়ে তাঁদের আদালতে পাঠানো হয়ে থাকে।
ঝিনাইদহের ওই বাড়ির পাশে মসজিদের সামনের খোলা জায়গায় স্থানীয় তরুণেরা বিকেলে ফুটবল খেলেন। এমন দুজন তরুণ বলেন, পাশের মেসের ‘সাঈদ ভাই’ তাঁদের সঙ্গে মাস খানেক বল খেলেছেন। সাঈদের সঙ্গে সারাক্ষণ আরেকজন থাকতেন, তাঁর নাম বলেছেন মোস্তাফিজুর রহমান। মোস্তাফিজ তাঁদের গান গেয়ে শোনাতেন, বেশির ভাগ হিন্দি গান। সাঈদ ইংরেজি গান শোনাতেন। তাঁরা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন, এ কারণে এখানে মেসে উঠেছেন বলে জানিয়েছিলেন।
গুলশান হামলার এক সপ্তাহ আগে ঢাকায় আসে নিবরাস : চার মাস আগে ঝিনাইদহ সদর থানা থেকে দুই কিমি দূরে সোনালীপাড়ায় চার কক্ষের ঘর ভাড়া নিয়ে আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে জঙ্গিরা। স্থানীয় ওই দুই তরুণের একজন বলেন, ঢাকায় জঙ্গি হামলার পর ফেসবুক আর পত্রিকায় ছবি দেখে তাঁরা জানতে পারেন, সাঈদের প্রকৃত নাম নিবরাস। গ্রামের দু-একজন মুরব্বিকে বলেছেন। ভয়ে খুব বেশি লোককে বলেননি, যদি আবার নিজেই বিপদে পড়েন।
নিবরাস ঠিক কত দিন ঝিনাইদহের ওই বাড়িতে ছিলেন, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বাড়ির মালিকের স্ত্রীর দাবি, আনুমানিক চার মাস আগে আসেন। ২৮ জুন চলে যান। আর ফুটবল খেলার সঙ্গী স্থানীয় তরুণেরা বলেছেন, মাস খানেক তাঁদের সঙ্গে নিবরাস খেলেছেন। সেটা কোন মাস, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ঢাকায় গুলশান হামলার মামলা তদন্তে যুক্ত একটি সূত্র জানায়, তারা তথ্য পেয়েছে, নিবরাস ও সঙ্গীরা ঝিনাইদহে ছিলেন ৩ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত। এরপর তিনি ৫ জুন থেকে বগুড়ায় ছিলেন। ২৫ জুন ঢাকায় আসেন।
১ জুলাই গুলশানে হামলাকারী এবং অভিযানে নিহত পাঁচজনের পরিবারের দাবি, তাদের সন্তান পাঁচ-ছয় মাস ধরে নিরুদ্দেশ বা ঘরছাড়া ছিলেন। গুলশান হামলার ছয় দিনের মাথায় শোলাকিয়ায় হামলাকারী এবং নিহত তরুণ আবির ১ মার্চ থেকে নিখোঁজ ছিলেন বলে পরিবার থানায় জিডি করে। গুলশানে হামলার পর নিবরাসের পরিবার বলেছে, নিবরাস ৩ ফেব্রুয়ারি বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিরুদ্দেশ হন। ৫ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। তাতে নিবরাসসহ তিন তরুণ নিখোঁজ হওয়ার কথা বলা হয়।
গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় হামলা চালিয়ে জঙ্গিরা ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যা করে। জিম্মি উদ্ধার অভিযানে ছয়জন নিহত হয়। এরপর আইএস পাঁচ হামলাকারীর ছবি প্রকাশ করে, যাঁদের মধ্যে নিবরাসের ছবিও রয়েছে। ঝিনাইদহের ওই বাড়িতে নিবরাস যদি চার মাস আগেও উঠে থাকেন, তার আগের এক মাস তিনি কোথায় ছিলেন, সে বিষয়ে এখনো কোনো তথ্য মেলেনি।
ঝিনাইদহ শহরের হামদহ সোনালীপাড়ায় ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, গাছপালায় ঘেরা একটি টিনের ঘর। মাত্র ১৫ হাত দৈর্ঘ্য আর ১২ হাত প্রস্থের টিনের ছাউনির একটি পাকা ঘর। ছোট ছোট চারটি কক্ষ। যার এক পাশে দারুস সালাম জামে মসজিদ, আরেক পাশে বাড়ির মালিকের ঘর। অন্য দুই পাশে কিছু খালি জায়গা। পুরো বাড়ি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা নিরিবিলি পরিবেশ। ঘরের ভেতরে কয়েকটি চেয়ার, টেবিল, চৌকি ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। দুটি কক্ষে আলনা আছে। কাঁথা-বালিশ ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে।
বাড়ির মালিকের স্ত্রী বিলকিস নাহার বলেন, তাঁদের ঘরের পশ্চিমে খালি জায়গায় একসময় গরু লালন-পালন করতেন। আশপাশের এলাকায় অনেক ছাত্র-মেস রয়েছে। তা দেখে তাঁরা বছর খানেক আগে খালি জায়গায় চার কক্ষের এই ঘর নির্মাণ করেন। জঙ্গিদের মেসে যিনি রান্নার কাজ করতেন তিনি বলেন, তিনি প্রতিদিন তিন বেলা এসে চারজনের রান্না করে দিতেন। কিন্তু থাকতেন আটজন। বাকি চারজন বলতেন, তাঁরা বাইরে খান। বেশির ভাগ সময় ভাতের সঙ্গে আলুভর্তা, ডিম আর ডাল রান্না করতেন। মাঝে মাঝে মাছ রেঁধেছেন। রান্নার কাজের ওই নারী বলেন, সেখানে একটি মোটরসাইকেল থাকত। সাঈদ (নিবরাস) বেশির ভাগ সময় মোটরসাইকেলে বাইরে যেতেন।
বাড়ির মালিক কওছার আলীর ভাই তাহের আলী বলেন, তাঁরা পাঁচ ভাই। তিনিসহ তিন ভাই আওয়ামী লীগের সক্রিয় সমর্থক। কাওছারসহ দুই ভাই সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। তাঁরা কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত নন। তিনি বলেন, ‘শুনেছি, কারা ওই বাড়িতে থাকত, যার কারণে ভাই কওছার বিপদে পড়েছে।’
কে এই ইমাম: জঙ্গিদের বাড়িভাড়ায় সহযোগিতা করেছিলেন যে মো. রোকনুজ্জামান, তিনি সোনালীপাড়া মসজিদে ইমামতির পাশাপাশি ২২ কিলোমিটার দূরের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। মসজিদ কমিটির দাবি, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করে গত বছরের ঈদুল ফিতরের সময় এখানে ইমাম পদে যোগ দেন রোকনুজ্জামান। থাকতেন মসজিদের দোতলায় একটি ঘরে।
রোকনুজ্জামান যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার হরিদ্রপোতা নায়ড়া গ্রামের মৃত আইনুদ্দিনের ছেলে। রোকনুজ্জামানের ভাই কামালুজ্জামান দাবি করেন, ‘আমার ভাই রোকনুজ্জামান ইসলামী ছাত্রশিবির বা কোনো ধরনের জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নয়। মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ঈদের আগের রাতে ঝিনাইদহের ওই মসজিদ থেকে তাকে আটক করে নিয়ে গেছে।’
কামালুজ্জামান বলেন, রোকনুজ্জামান যশোরের বাগআঁচড়া সিদ্দিকিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাস করার পর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি ফিকাহ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ওই মসজিদের সহযোগী ইমাম সাব্বির হোসেন সোনালীপাড়ার আবুল কালাম আজাদের ছেলে। সাব্বির ঝিনাইদহ সিদ্দিকিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে। এরপর সে পটুয়াখালীর ছারছিনা দারুস সুন্নাত কামিল মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে নবম শ্রেণির ছাত্র। তবে বেশির ভাগ সময় বাড়িতে থাকে এবং মসজিদে সহযোগী ইমামের দায়িত্ব পালন করত বলে এলাকার লোকজন জানান।
ঝিনাইদহে বিভিন্ন হত্যা: স্থানীয় লোকজন বলছেন, জঙ্গিরা এই বাড়িতে ওঠার পর গত চার মাসে ঝিনাইদহে ঘটেছে দুটি আলোচিত হত্যাকাণ্ড। এর মধ্যে গত ৭ জুন সদর উপজেলার করাতিপাড়ায় পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীকে এবং ১ জুলাই মঠের সেবায়েত শ্যামানন্দ দাসকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
এর আগে একজন ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান এবং একজন শিয়া মতাদর্শের ব্যক্তিকে একই কায়দায় খুন করা হয়। এসব খুনের ঘটনায় শুরু থেকেই জঙ্গিদের সন্দেহ করা হলেও পুলিশ এখন পর্যন্ত কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। থানা থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে এত দিন ধরে জঙ্গি আস্তানায় দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা অবস্থান করছিল, কিন্তু পুলিশ টের পেল না। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ বলেন, ওই এলাকায় কিছু মেস আছে। মাঝেমধ্যে সেখানে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু কোনো জঙ্গি আস্তানা ছিল বা সেখান থেকে কাউকে আটক করা হয়েছে, এমন কোনো তথ্য তাঁর জানা নেই।-প্রথম আলো
১৫ জুলাই, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ