খুলনা থেকে : খুলনার একসময়ের মূর্তিমান আতঙ্ক ও দেশের বহুল আলোচিত ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর হওয়া ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী আন্ডারওর্য়াল্ড ডন এরশাদ শিকদারের নামে এখনও চলছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম।
এরশাদ শিকদারের ঘাট হিসেবে পরিচিত খুলনা নগরীর ৫ নম্বর ঘাট এলাকায় ১৯৮৯ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করে সে। রেলওয়ের ৪৯ শতক জমির ওপর নির্মিত বিদ্যালয়টির নাম দেওয়া হয় 'এরশাদ আলী প্রাথমিক বিদ্যালয়'। ২০০৪ সালের ১০ মে এরশাদ শিকদারের ফাঁসি কার্যকর হলেও বিদ্যালয়টি নাম পরিবর্তন করা হয়নি।
স্থানীয়রা কয়েকদফা চেষ্টা করেও বিদ্যালয়টির নাম বদলের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নাম পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি বলে জানা গেছে। ভয়ঙ্কর এই খুনির নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগে থেকেই হিনমন্যতা কাজ করছে।
জানা যায়, রেলওয়ের ৪৯ শতক জমির ওপর ১৯৮৯ সালে ‘এরশাদ আলী প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি বিদ্যালয়টি রেজিস্টার্ড বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে ১ জানুয়ারি সরকারিকরণ হলে স্কুলটির নাম হয় ‘এরশাদ আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’।
সেখানে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলের একতলা ভবনের গায়ে বড় বড় অক্ষরে 'এরশাদ আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়' নাম লেখা। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা বা ইতিহাস জানতে চাইলে তারা কিছুই বলতে পারে না।
খুলনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পারভীন জাহান জানান, সরকারীকরণ হওয়ার আগে স্কুলের নাম পরিবর্তন করতে হলে সরকারি কোষাগারে আনুমানিক তিন লাখ টাকা জমা দেওয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে আবেদন করতে হতো। সরকারি হওয়ায় পরে নাম পরিবর্তন করতে আইনি বিধান রয়েছে কি-না, তা মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে হবে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শওকত আলী বলেন, ২০০১ সালে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানে তৎকালীন খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলী আজগার লবী স্কুলটির নাম পরিবর্তনের দাবি করলেও পরে বিষয়টি আর সামনে এগোয়নি।
কে এই এরশাদ শিকদার?
এরশাদ শিকদারছিলেন একজন কুখ্যাত অপরাধী ও সিরিয়াল কিলার। খুন, অত্যাচার, চুরি-ডাকাতি ও অন্যান্য নানা অপরাধের দায়ে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়, যা ২০০৪ সালের মে মাসের ১০ তারিখে কার্যকর করা হয়। এরশাদ শিকদারের রচিত ‘আমি তো মরে যাবো, চলে যাবো, রেখে যাবো সবই। আছস নি কেউ সঙ্গের সাথী সঙ্গে নি কেউ যাবি আমি মরে যাবো’ গানটি পরবর্তীতে দেশ জুড়ে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
এরশাদ শিকদারের জন্ম ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার মাদারঘোনা গ্রামে। তার পিতার নাম বন্দে আলী। ১৯৬৬-৬৭ সালে তিনি তার জন্মস্থান নলছিটি থেকে খুলনায় চলে আসেন। খুলনায় আসার পর এরশাদ সেখানে কিছুদিন রেলস্টেশনের কুলির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে রেললাইনের পাত চুরি করে বিক্রি করত এমন দলের সাথে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি তাদের নিয়ে নিজেই একটি দল গঠন করেন ও এলাকায় রাঙ্গা চোরা নামে পরিচিতি পান।
১৯৭৬-৭৭ সালে তিনি রামদা বাহিনী নামে একটি দল গঠন করেন যারা খুলনা রেল স্টেশন ও ঘাট এলাকায় চুরি-ডাকাতি ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকত। এই রামদা বাহিনী নিয়েই এরশাদ ১৯৮২ সালে ৪ ও ৫ নম্বর ঘাট এলাকা দখল করেন এবং একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
১৯৮২ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ ক্ষমতা দখল করার পর তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। সামরিক শাসক এরশাদের আমলে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে তিনি তৎকালীন ৮ নম্বর ওয়ার্ডের (বর্তমান ২১ নম্বর ওয়ার্ড) কমিশনার নির্বাচিত হন।
১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করার পর এরশাদ শিকদার বিএনপিতে যোগদান করেন। ১৯৯৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর এরশাদ আবারো দল পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন কিন্তু সমালোচনার মুখে কিছুদিন পরই আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গ্রেফতার হওয়ার সময়ও তিনি ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার ছিলেন।
রাজনীতিতে প্রবেশ করার পর এরশাদ আরো ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেন। তিনি ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি খুলনার রেলওয়ের সম্পত্তি দখল, জোড়পূর্বক ব্যক্তিগত সম্পত্তি দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন।
১৯৯১ সালে তিনি ৪ নম্বর ঘাট এলাকা থেকে রফিক নামে একজন বরফকলের মালিককে ভয় দেখিয়ে বিতাড়িত করে, বরফকল দখল করেন এবং সকল ব্যবসায়ীদেরকে তার কল থেকে বরফ কিনতে বাধ্য করেন।
এছাড়াও জানা যায় তিনি বরফ কলটি তার নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতেন। এরশাদের বিরুদ্ধে ৬০টিরও বেশি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনেন তার এক সময়ের সহযোগী ও পরবর্তীকালে রাজসাক্ষী নূরে আলম। নূরে আলম ২৪টি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন। নূরে আলম আরো স্বাক্ষ্য দেন, এরশাদের কাছে ৭০টিরও বেশি আগ্নেআস্ত্র রয়েছে যদিও তার স্বর্ণকমল নামে খ্যাত বাড়ি থেকে মাত্র একটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল।
বিভিন্ন মাধ্যমে এরশাদের ৬টি বিয়ের কথা জানা গিয়েছিল। তার প্রথম স্ত্রীর নাম খোদেজা বেগম; ১৯৭৩ সালে তিনি খোদেজার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সানজীদা আক্তার শোভা নামে তার আরেক স্ত্রীর কথাও জানা যায়, যাকে তিনি তার বিলাসবহুল বাড়ি স্বর্ণ কমলে এনেছিলেন।
এছাড়াও রূপসার রাজাপুর গ্রামের তসলিমা, বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার ফরিদা, সহযোগী বারেক কমান্ডারের স্ত্রী রামেছা এবং যাত্রাদলের নায়িকা পাইকগাছার দুর্গারানী কথা জানা যায়। এছাড়াও নূরে আলমের স্বাক্ষ্যমতে তার স্ত্রী হীরাকে বিয়ের রাতেই এরশাদ (প্রকাশ অযোগ্য শব্দ) করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এরশাদের প্রথম স্ত্রী খোদেজার গর্ভে এরশাদের চারটি সন্তান জন্ম নেয় যার মধ্যে তিনটি ছেলে ও একটি মেয়ে। এছাড়া গ্রেফতারের পর শোভার গর্ভে এষা নামে এক মেয়ের জন্ম হয়।
১৯৯৯ সালে এরশাদ শিকদার গ্রেফতার হন ও তার নামে তখন ৪৩টি মামলা হয়েছিল। নিম্ন আদালতের বিচারে সাতটি হত্যা মামলায় তার ফাঁসির দণ্ডাদেশ হয় ও চারটি মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয়। তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন কিন্তু রাষ্ট্রপতি তার আবেদন নাকচ করে দেন এবং ২০০৪ সালের ১০ মে মধ্যরাতে খুলনা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
১৩ ডিসেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসবি