মৌলভীবাজার থেকে: প্রশাসনের চোখে আঙ্গুলে দিয়ে মৌলভীবাজার জেলায় সক্রিয় শতাধিক দাদন (সুদ) ব্যবসায়ী। দাদন ব্যবসায়ীদের ছুবলে পড়ে এজেলার অনেক সহজ সরল মানুষ ভিটা মাটি হারিয়ে এখন রাস্তায় দিনাতিপাত করছেন। এ ব্যবসায় বিত্তমানরা রাতারাতি আরো ধনী হচ্ছেন আর খেটে খাওয়া অসহায় মানুষগুলো সর্বস্ব হারাচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের কিছু অসাধু নেতাকর্মীদের ম্যানেজ করে নির্ধিদায় চলছে একাজ। জানা যায়, সুদের টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নের ছয়টি পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করছে উপজেলার দাদন স¤্রাট আসুক মিয়া। এর বাহিরেও তিনি অনেক হতদরিদ্র পরিবারের মেয়েদের নিয়ে শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন হোটেল ও রিসোর্টে রাত্রি যাপন করার অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়াও সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় বিয়ে করেছেন ওই ইউনিয়নের মিনার মিয়া ও তুয়াহিদ মিয়া। গত মাসে এ সংক্রান্ত বিষয়ে সদর উপজেলার পাগুড়িয়া এলাকার মুদি ব্যবসায়ী রিপন মিয়া খুন হন। দাদন ব্যবসায়ীদের দায়ের করা মামলায় অনেকেই এখন দিশেহারা। কেউ কেউ পুলিশের গ্রেফতার এড়াতে বাড়ি ঘর ছেড়ে আত্মগোপনে আছেন।
একটি বিশ্বস্থ সূত্রে জানা যায়, সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নের ক্ষেমসহ¯্র গ্রামের আবিদ উল্লার মেয়ে মজনু বেগমকে, শ্রীভোগ গ্রামের গনি ড্রাইভারের মেয়েকে, কেওলা গ্রামের রাজনা বেগমকে, পাঁচগাঁও গ্রামের চেরাগ মিয়ার মেয়ে নাজমা বেগমকে বিয়ে করেন দাদন স¤্রাট আসুক মিয়া। এর বাহিরেও আরো ৩/৪টি বিয়ে করেছেন এই আসুক। সুদের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় শত্রমর্দন গ্রামের গনি মিয়ার ভাগনীকে বিয়ে করেন মিনার মিয়া। সূত্র আরো জানায়, টাকা পরিশোধ করতে না পারায় সুদ ব্যবসায়ী তারেক রহমান কর্ণেল আমিরপুর গ্রামের তুতা মিয়া ও রুবিয়া বেগম এর বসত বাড়ি জোরপূর্বক রেজিষ্ট্রার করে নিয়েছেন।
পরিচয় গোপন রেখে দাদন স¤্রাট আসুক মিয়ার কাছে সুদের টাকা চাইলে তিনি বলেন- ‘এ ব্যবসা এখন বাদ দিয়ে দিছি। পরে পরিচয় দিয়ে বিয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে একটি বিয়ের কথা স্বীকার করে তিনি ফোন কেটে দেন’।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ ব্যবসার সাথে স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি, জনপ্রতিনিধি, সরকার দলের নেতাকর্মী, স্বর্ণ ব্যবসায় ও এলাকার মাতব্বর সহ কয়েক শতাধিক মানুষ জড়িত। গত কয়েক মাস আগে জেলা আইন শৃঙ্খলা সভায় আলোচনা হলেও এপর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। যার ফলে এটা দিন দিন চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। জেলার অনেক গ্রামগঞ্জে এটা এখন অপেন সিক্রেট। স্থানীয়দের অভিযোগ প্রশাসনকে একাধিকবার অবগত করার পরেও এপর্যন্ত কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। যার ফলে এটা দিন দিন লাগামহীন ভাবে বাড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সদর উপজেলার সাদুহাটি আব্দুল বারী উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ফরিদ মিয়া দীর্ঘ দিন যাবত প্রকাশ্যে লক্ষ লক্ষ টাকার দাদন ব্যবসা করে আসছেন। তিনি প্রভাবশালী থাকায় মুখ খোলে এলাকার কেউ প্রতিবাদ করতে পারছে না। দাদন ব্যবসা করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছেন রাজনগর উপজেলার মনিপুর গ্রামের মোঃ পারভেজ আলী। টাকা দেয়ার সময় দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে ব্ল্যান চেক রেখে পরবর্তী টাকা দিতে না পারায় অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও দিয়েছেন তিনি।
এব্যবসার সাথে জড়িত আছেন, সদর উপজেলার হলিমপুর গ্রামের পবলু মিয়া, জগন্নাতপুরের শামীম আহমদ, বাদে ফতেহপুরের আসাদ মিয়া, বেকামুড়ার মাহমদ মিয়া। রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নের শফিক মিয়া, হাত কাটা কুটি, আজিজুল, কদর মিয়া, রুমেল, সিকদার, আব্দুল হক সেফুল, মজমিল, আসুক মিয়া, সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুল মুকিত, বর্তমান ইউপি সদস্য তারেক রহমান কর্ণেল, আখই মিয়া, উকুল আলী। ঘরগাঁও এলাকার একিন মিয়া, সে ু মিয়া-১, সে ু মিয়া-২, ফরব মিয়া, শামীম মিয়া, উত্তর ঘরগাঁও এলাকার শাহিন মিয়া। টেংরা ইউনিয়নের সৈয়দ নগর গ্রামের নজির মিয়া, বদরুল মিয়া, আনর মিয়া, মন্নান, মসাহিদ, জসিম। আকুয়া গ্রামের শাহাজান, কয়েছ। এছাড়াও জেলার বড়লেখা, জুড়ী, কুলাউড়া, রাজনগর, কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার ছোট-বড় বাজার গুলোতে প্রকাশ্যে দাদন ব্যবসা চলছে।
দাদন ব্যবসায়ী সদর উপজেলার সাদুহাটি আব্দুল বারী উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ফরিদ মিয়া বলেন, “বরাক” নামে আমার একটি সমিতি আছে। এটার মাধ্যমে সরকার বাজারের কিছু ব্যবসায়ীদের কাছে ঋণ দেই। পরিচয় গোপন রেখে আসাদ মিয়া’র সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমার হাতে কোনো টাকা নেই। সব টাকা মাঠে। এই মুহুর্তে দিতে পারব না। মাহমদ মিয়া বলেন, হাতে কোনো টাকা নেই। ভাই এখন দেয়া যাবে না।
মামলার বাদী রাজনগর উপজেলার মনিপুর গ্রামের দাদন ব্যবসায়ী মোঃ পারভেজ আলী বলেন, আমি বলতে পারব না মরির সাথে যোগাযোগ করেন। মামলার বাদী হিসেবে আপনি জানার কথা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরাসরি দেখা হলে বিস্তারিত বলব।
মামলার বিবাদী মোঃ ফখরুল ইসলাম বলেন, ব্ল্যান চেক দিয়ে পারভেজ আলীর কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা নেই। পরবর্তী ১০ লক্ষ টাকার মামলা দায়ের করেন। এভাবে তিনি এলাকার প্রায় ৫/৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছেন।
এবিষয়ে জেলা আওয়ামীলীগের এক নেতা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে বিভিন্ন ঝামেলা হওয়ায় হত দরিদ্র মানুষ দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আনছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে দাদন ব্যবসার জন্য অনেকটাই প্রশাসন দায়ী। বিষয়টি প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা দেখেও না দেখার বান করছেন।
এমটি নিউজ/এপি/ডিসি