নড়াইল প্রতিনিধি: বছরের বিভিন্ন সময়ে নানা উৎসবের আয়োজনে নিরাপত্তার দ্বায়িত্বে থাকে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা দলের (ভিডিপি) সদস্যরা। তাদের নিয়োগ দেন স্থানীয় আনসার কমান্ড্যান্ড ও অফিসাররা। সারা বছরই এসব আনসার নিয়োগে অর্থ বানিজ্যের অভিযোগ উঠলেও করার কিছু নেই দরিদ্র আনসার সদস্যদের।
অনিয়মের ব্যাপারে কথা বললে সেই সদস্য পরে আর ডিউটি পাবেন না এই ভয়ে সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে যা পান তাই নিয়েই খুশী থাকেন আনসার সদস্যরা। এবারের দুর্গাপূজার ডিউটিতে ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ডিউটি দেওয়া কয়েক হাজার আনসার ভিডিপি সদস্যদের প্রত্যেকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিয়োগের অভিযোগ রয়েছে।
নড়াইলে এবার দুর্গাপূজার নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত আনসার সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এলাকার আনসার ইউনিয়ন কমান্ডারদের মাধ্যমে জেলা অফিসে ঘুষ প্রদান করে নিয়োগ পাবার ব্যাপারে অভিযোগ করেছেন নিয়োগকৃত এ সকল গ্রামের হতদরিদ্র্য শ্রেণির লোকেরা। ভয়ে অনেকে মুখ খুলতে চান না পরবর্তীতে আবার ডিউটি না পাবার আশংকায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ বছর জেলায় মোট ৬০২ টি দুর্গাপূজা মণ্ডবে পুলিশের পাশাপাশি আনসার সদস্যরা দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করেছে। পূজা মণ্ডবের পরিধি বুঝে ৫ ধেকে ৮জন আনসার সদস্য একেকটি মণ্ডবে পূজার ষষ্টি অর্থাৎ ২৬ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিউটি পালন করেছে। ৫দিন ৫ রাত একটানা ডিউটি করে তাদের হাতে এসেছে ১৬’শ টাকা, আর যিনি পিসি অর্থাৎ গ্রুপ লিডার তিনি পেয়েছেন ১৭’শ।
জেলা আনসার অফিসের সূত্রে জানা যায়, এ বছর জেলার ৪টি থানার আওতায় ৬০২টি পূজা মণ্ডপে মোট ৩হাজার ২’শ ৭০ জন আনসার ও ভিডিপি সদস্য নিয়োজিত ছিলেন। এর মধ্যে নড়াইল সদরে ১হাজার ৪’শ ৯৪ জন, লোহাগড়ায় ৯’শ ৬২, কালিয়ায় ৪’শ ৮৬ এবং নড়াগাতী থানাতে ৩’শ ২৮ জন।
গত ২ অক্টোবর থেকে জেলা ও উপজেলা আনসার কার্যালয়ে পূজায় কর্মরত আনসার সদস্যদের মজুরী পরিশোধ করা হলেও গরীব আনসার সদস্যদের ক্ষোভের শেষ নেই। নিয়োগকৃতদের অভিযোগ, নিয়োগের আগেই তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৪’শ থেকে ৬’শ টাকা করে নিয়েছে স্থানীয় ইউনিয়ন কমান্ডার ও এজন্টরা।
৩ অক্টোবর দুপরে জেলা আনসার অফিসে গিয়ে আনসার সদস্যদের টাকা নেওয়ার সময় ভুক্তভোগীরা টাকা নিয়ে নিয়োগের অভিযোগ তোলেন। এ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত আনসার অফিসের এজেন্ট এবং আনসার কর্মকর্তারা টাকার বিষয়ে না বলার জন্য কয়েকদফা শাসিয়ে যায়। সাংবাদিক যাবার পর থেকেই স্থানীয় ইউনিয়ন কমান্ডাররা অর্থ নেওয়ার কথা না বলার জন্য সকলের সামনেই দেখে নেবার হুমকী প্রদান করেন।
সদর উপজেলার আউড়িয়া ইউনিয়নের সীমাখালী গ্রামের আকছির পূজার পাঁচদিন ডিউটি করেছেন পূর্বসীমাখালী মন্দিরে। অভিযোগ করে বলেন, আমার গ্রুপের ৭ জনের কাছ থেকে আউড়িয়া ইউনিয়ন কমান্ডার আলী মিয়া ৪’শ টাকা করে ২৮’শ টাকা আগেই নিয়ে নিয়ে নিয়েছে, ডিউটির আগে বলেছিলো ২৫’শ টাকা করে পাব এখন পেলাম ১৬’শ টাকা।
নাকশী গ্রামের নজরুল ইসলাম জানান, আমাদের ডিউটি ছিল কমলাপুর দক্ষিণ কালীবাড়িতে, আমাদের ৬ জনের গ্রুপে ডিউটি দেওয়ার আগেই অফিসে দেওয়ার কথা বলে ৪’শ টাকা করে মোট চব্বিশ’শ টাকা নিছে কমান্ডার আলী। ৫দিন ডিউটি করার পরে এই টাকা, আমাদের ঠকিয়ে বড় হচ্ছে আনসারের অফিসাররা।
তুলারামপুর ইউনিয়নের কিশোর রাশেদ জানায়, বড় শখ করে পূজার ডিউটিতে যাওয়ার জন্য ধরনা দেয় স্থানীয় আনসারের এজেন্ট বাবর আলীর কাছে। বাবর আলী তাকে ডিউটি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ৫’শ টাকা নেয়। সে বেনাহাটি পূজামন্দিরে ৫দিন ডিউটি করে পেয়েছে ১৬’শ টাকা। তার মতো আরেক জন ইকরামের কাছ থেকে নিয়েছে ৬’শ টাকা। বেশী টাকা দেওয়ার কথা বলে কাজে যোগ দিয়ে ১৬’শ টাকা পেয়ে হতাশ ইকরাম।
শিমুলতলী গ্রামের মনষা মন্দীরে ডিউটি করা দিনবন্ধু হাজরা অভিযোগ করে বলেন, ইউনিয়ন কমান্ডার শাহিদা ডিউটি দেওয়ার আগে আমার কাছ থেকে ৫’শ টাকা নেছে। দেওয়ার কথা ছিলো ২৫’শ টাকা এখন পাইছি ১৬’শ টাকা।
একইভাবে ৫’শ টাকা থেকে ৬’শ টাকা দিয়ে ডিউটি পেয়েছেন শাহাবাদের সুবাস চাকি, জুড় লিয়ার জাকির, মুলিয়ার চন্দনা, দূর্বাজড়ির কল্পনা, আউড়িয়ার সাজাহান শেখ, বিছালীর মিলন সিকদার, মির্জাপুরের শরীফ, ইনামুলতুলারামপুরের ইমন এর মতো শত শত নারী ও পুরুষ আনসার-ভিডিপি সদস্য। কালিয়া ও লোহাগড়ার অবস্থা একই রকম বলে স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
টাকা দিয়ে ডিউটি নেওয়া এসকল ভূক্তভোগী আনসার ভিডিপি সদস্যদের কাছ থেকে জানা যায়, প্রতিটা কাজে আনসার নিয়োগের সময় জেলা অফিসে টাকা দেওয়ার জন্য আগে থেকেই ইউনিয়ন কমান্ডার কিংবা স্থানীয় এজন্টেদের মাধ্যমে টাকা নিয়ে থাকে এসব টাকা অফিসের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা জসিম উদ্দিনের কাছে জমা হয়ে ভাগবাটোয়ারা হয়।
সাংবাদিক দেখে অধিকাংশ অভিযুক্ত ইউনিয়ন কমান্ডার সটকে পড়েন। পরে আউড়িয়া ইউনিয়ন কমান্ডার আলী হোসেনের সাথে কথা বললে অভিযোগের ব্যাপারে বলেন, এগুলো সব মিথ্যা অভিযোগম কয়েকজন লোক সাজিয়ে এনে তিনি বলেন, এদের কাছে জিজ্ঞেস করেন আমাকে ওরা টাকা দেছে কিনা।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন বলেন, গত বছর পূজার পরে অফিসে ডিউটি দেওয়ার জন্য আমাদেও কাছ থেকে ঘুষের টাকা কেটে নিচ্ছিল, সাংবাদিকরা এসে পড়ায় সেটা সম্ভব হয়নি। তাই এবার ডিউটির আগেই টাকা নিয়ে নিচ্ছে অফিসার, এখন টাকা যা পাবার তাই পাচ্ছি, কিন্ত আমরা তো ঘুষের টাকা আগেই দিয়েছি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলা আনসার কমান্ড্যান্ট, মো. আতাউর রহমান এর যোগসাজসে সদর উপজেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা ও উপজেলা কমান্ড্যান্ড এর দ্বায়িত্বে থাকা অর্পনা ও আরেক প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা জসিমউদ্দিন প্রত্যেকবার নানা কৌশলে দরিদ্র আনসার সদস্যদের কাছ থেকে ডিউিটিতে নিয়োগ পাইয়ে দেওয়ার সুযোগে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেন। এই কাজে ব্যবহার করা হয় স্থানীয় ইউনিয়ন কমান্ডারদের। যেসব এলাকায় কমান্ডাররা তাদের কথামতো কাজ করেন না সেসব এলাকায় নিজস্ব এজেন্ট তৈরী করে তাদের মাধ্যমে আনসার সদস্য নিয়োগ দেন।
অধিকাংশ সময়ে নিয়োগকৃত আনসার সদস্যদের কোন প্রশিক্ষণ বা আনসারে অন্তর্ভূক্তি না থাকায় তাদের দুর্বলতার সুযোগ কাজে লাগান দুর্নীতিবাজ এ সকল কর্মকর্তারা।
নড়াইল জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী হাফিজুর রহমান বলেন, প্রতিবারই আনসার নিয়োগে দুর্নীতির কথা শোনা যায়। বিষয়টি তদন্ত করলে সত্যতা বেরিয়ে আসবে। বিষয়টি নড়াইলের দুর্নীতির গনশুনানীতে ওঠার পরে ও থামেনি। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করলে এই দুর্নীতি বন্ধ হতে পারে।
নড়াইল সদর উপজেলা আনসার প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা জসিমউদ্দিন অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের কোন লোক টাকা নিয়ে থাকলে তার প্রমাণ দিন। প্রমাণ দিতে পারলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রতিবারের আনসার নিয়োগে দুর্নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এবারের বিতরণ জেলার প্রশাসনের কর্মকর্তাদের হাত দিয়ে শুরু হয়েছে।
জেলা আনসার কমান্ড্যান্ট মো. আতাউর রহমান মোবাইল ফোনে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে অনেকটা রেগে যান। তিনি অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, এজাতীয় কোন অভিযোগই গ্রহণ যোগ্য নয়। তাছাড়া আমার দোষ কোথায়? আমি টাকা বিতরণ তিন উপজেলা কমান্ড্যান্ড এর মাধ্যমে করছি। এখন ব্যস্ত আছি। টাকা বিতরণ করছি। এ কথা বলে তিনি লাইন কেটে দেন।-কালের কণ্ঠ
এমটি নিউজ/আ শি/এএস