কোনো কাজই যে ছোট নয় সে কথা আরেকবার প্রমাণ করে দিয়েছেন নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী সৈয়দ সজিবুর আলভী (২৩)।
নিজের শখের ল্যাপটপ বিক্রি করে টং দোকান দিয়েছেন তিনি। এখান থেকে প্রতিমাসে তিনি আয় করছেন প্রায় ২৫-৩০ হাজার টাকা। যা দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চলছে তার পড়াশোনা। এমনকি পরিবারের পাশেও দাঁড়াতে পারছেন তিনি। এদিকে শিক্ষিত তরুণের এমন উদ্যোগকে প্রথমে কেউ ভালোভাবে না নিলেও এখন সাধুবাদ জানাচ্ছেন সবাই।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, নড়াইলের ঐতিহ্যবাহী বাধাঁঘাটের সামনে ছোট্ট একটি টং দোকান দিয়েছেন আলভী। সেখানে কখনও কেতলি হাতে চা বানাচ্ছেন তিনি। তার দোকানে সাধারণ রং চা থেকে শুরু করে তান্দুরি, তেঁতুল, অপরাজিতা, কাশ্মীরি, বুলেট, বিটরুট, তুলসী, বাম্বু, মালাই ও বাদামসহ ২০ প্রকারের চা। ৫ টাকা থেকে শুরু করে প্রকারভেদে এসব চা বিক্রি হয় ৫০ টাকা পর্যন্ত।
এছাড়া লেবুর পিনিক ও সুস্বাদু চিকেন মোমোও বিক্রি করছেন তিনি। আর এসব খাদ্যের স্বাদ নিতে প্রতিদিন তার দোকানে ভিড় করছেন নানান বয়সী মানুষ।
খাবারের মান ভালো হওয়ায় সকলের প্রশংসা কুঁড়াচ্ছেন তিনি। এছাড়া আলভীর দোকানে রয়েছে স্টিকি নোটের ব্যবস্থা। খাওয়ার পর খাবারের মান কেমন ছিলো তা লিখে একটি বোর্ডে লাগিয়ে রাখতে পারবেন যে কেউ।
দোকানে চা খেতে আসা নড়াইল পৌরসভার ভওয়াখালীর উৎস বিশ্বাস বলেন, প্রথম থেকে আমি এই দোকানে বসি, আড্ডা দেই এবং খাবার খাই। দোকানদার সবার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেন।
বর্তমান সময়ে কলেজ-ভার্সিটিতে যারা লেখাপড়া করে তারা অবসর সময় আড্ডা দিয়েই কাটিয়ে দেয়। কিন্তু আলভী ভাই পড়ালেখার পাশাপাশি যে নিজে আত্মকর্মসংস্থান গড়ে তুলেছে এটা সত্যিই প্রশংসানীয়।
লিজা হাসান বলেন, আমি আলভীকে অনেকদিন ধরে দেখছি। সে অনার্সের ছাত্র পাশাপাশি তার একটি চায়ের স্টল আছে। সে নিজে স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করছে।
এটা আসলে একটা ইতিবাচক দিক। আমাদের দেশের জন্য একটা বড় বিষয়। যারা লেখাপড়া শিখে চাকরি-বাকরি না পেলে নিজে স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করবে তাদের জন্য আলভী একটা অনন্য উদাহরণ।
ফাতেমা মেহেজাবিন মিম নামে একজন জানান, এটি খুবই ভালো কাজ। পরবর্তী প্রজন্মকে ব্যবসা বা নিজে কিছু করতে অনুপ্রেরণা দেবে।
পিয়াস কর্মকর বলেন, এই দোকানে আমি প্রথম মোমো অর্ডার করেছিলাম। মোমোটা খুব ভালো লেগেছিল। আমাদের প্রত্যেকেরই উদ্যোক্তা হওয়া উচিত। আলভী ভাই পড়াশোনার পাশাপাশি যেভাবে একটি দোকান চালাচ্ছে এবং নিজের পরিবারকে স্বাবলম্বী করে তুলছে এটা অনেক বড় ব্যাপার।
তরুণ উদ্যোক্তা আলভী বলেন, এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে নড়াইল থেকে ঢাকা গিয়েছিলাম চায়নিজ ভাষা শিখতে। সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি একটি খাবারের দোকোনে চাকরি নেই। কাজ ঠিকঠাক করলেও বেতন ঠিকমত পেতাম না। এরপর ঠিক করি নিজে উদ্যোক্তা হব। চায়ের দোকান দেব।
তবে একথা বাড়িতে জানালে কেউ তা মেনে নেয়নি। পরিচিত কেউই তেমন ভালোভাবে নেয়নি। তবে কারো কথায় কান না দিয়ে নিজের স্বপ্নের পেছনে ছুটেছি। ২০২২ সালে এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে এবং শখের ল্যাপটপ বিক্রি করে দোকান শুরু করি।
এরপর লোন নিয়ে বন্ধুর ধার পরিশোধ করেছি। কয়েক মাসের মধ্যে লোনটিও পরিশোধ হয়ে গেছে। বর্তমানে এই দোকানের আয় দিয়ে পড়াশোনা ও ব্যক্তিগত খরচ মিটিয়ে পরিবারেও য়টাকা দিচ্ছি। ভবিষ্যতে বড় একটি রেস্টুরেন্ট করার স্বপ্ন রয়েছে।
আলভী বলেন, বর্তমানে বেকরত্ব একটা সামাজিক ব্যাধি। নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হওয়া খুবই দরকার। লেখাপড়ার পাশাপাশি ছোট কিছু নিয়ে শুরু করলে ইনশাঅল্লাহ সামনে ভালো কিছু করা সম্ভব। চাকরির যে বাজার তা ধরতে গেলে অনেক সমস্যা।
তাই আমি মনে করি যে নিজে আত্মবিশ্বাসী হয়ে, উদ্যোক্তা হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাজ শুরু করলে অনেকে অনেক কথা বলবে। কিন্তু পরে সবাই সমর্থন করবে ইনশাঅল্লাহ। প্রথম পর্যায়ে কেউ কারো পাশে থাকে না। তাই বেকার যারা আছে তাদের কাজ শুরু করা উচিত বলেও মনে করেন তরুণ এই উদ্যোক্তা।
নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক খান শাহাবুদ্দিন বলেন, এটা নিঃসন্দেহে একটা ভালো উদ্যোগ।
কারণ বর্তমান যে প্রেক্ষাপট তাতে আসলে লেখাপড়া শিখে চাকরি বা অন্য পেশায় যাওয়ার সুযোগ খুব কম। আর সেক্ষেত্রে আলভীর উদ্যোগ অনুকরণীয়।
পরিবারের সহযোগিতা ছাড়াই নিজের পায়ে নিজে দাঁড়ানো, সমাজ এবং পরিবারের বোঝা না হয়ে যে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা করা এটা প্রশংসার যোগ্য বলেও মনে করেন তিনি। সূত্র : ঢাকা পোস্ট