নাজমুল ইসলাম নাঈম, পঞ্চগড় প্রতিনিধিঃ ‘ভিতরগড় দূর্গ নগরী’ শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি অংশ। বাংলাদেশে এ যাবৎ প্রাপ্ত প্রাচীন দূর্গনগরী গুলির মধ্যে সর্ব বৃহৎ ভিতরগড় দূর্গ নগরী। প্রাচীন সভ্যতার পুরাকীর্তি আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই ভিতরগড়। কিন্তু প্রশাসনের অবহেলায় দিনে দিনে নষ্ট হচ্ছে, ভিতরগড়ের অমূল্য প্রতœসম্পদ। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্যেও ভিতরগড় প্রত্ন সীমানায় গড়ে ওঠেছে বিজিবির ক্যাম্প, চা বাগানসহ নানা স্থাপনা। এভাবেই একটু একটু করে ধ্বংস হচ্ছে ভিতরগড়ের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্র্শন। এছাড়াও স্থানীয় কিছু সংখ্যক অধিবাসীদের অসচেতনতায় ধ্বংসের মুখে পড়েছে ভিতরগড়ের সহ¯্র বছরের পুরাকীর্তি।
ভিতরগড় দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড় শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রায় ২৫ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে অবস্থিত। প্রাচীন এই দূর্গনগরীর মাটির নিচে লুকিয়ে আছে প্রাচীন সভ্যতার নানা ইতিহাস ও অসংখ্য স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ এবং মূল্যবান প্রতœবস্তু। মাটি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসছে দুর্লভ সব প্রাচীন স্থাপনা।
চারটি আবেষ্টনী দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত ভিতরগড় দূর্গনগরী বাংলাদেশে অদ্বিতীয়, এখানে আবিষ্কৃত স্তম্ভ¢বিশিষ্ট বারান্দা সম্বলিত স্তূপটি বাংলাদেশে এ যাবৎ আবিষ্কৃত একমাত্র স্থাপত্যিক নিদর্শন। ভিতরগড়েই রয়েছে, চাষাবাদের জন্য সেচ ব্যবস্থা ও নদীর পানি নিয়ন্ত্রণের নিমিত্তে পাথরের বাঁধ নির্মাণের নৈপুন্য কৌশলের অনন্য উদাহরণ। এ দূর্গনগরীর অভ্যন্তরেই রয়েছে মহারাজা দীঘি। মহারাজা দীঘির ইট বাঁধানো দশটি ঘাট এবং ঘাটের উভয় পাশে ইট ও মাটি দিয়ে নির্মিত সুউচ্চ পাড় নৈসর্গিক দৃশ্যের এক অসাধারণ নিদর্শন। ভিতরগড় দূর্গনগরীর বাইরের আবেষ্টনীর উত্তরাংশ, উত্তর-পশ্চিমাংশ এবং উত্তর-পূর্বাংশ বর্তমানে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত হওয়ায় ধারণা করা হয় যে, ৬ষ্ঠ শতকের শেষে কিংবা সপ্তম শতকের শুরুতে ভিতরগড় একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং প্রাচীন বাণিজ্য সড়ক ও নদীপথের উপর অবস্থিত হওয়ায় ভিতরগড় এলাকার অধিবাসীরা সম্ভবত নেপাল, ভূটান, সিকিম, আসাম, কুচবিহার, তিব্বত, চীন, বিহার, এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ বাংলার সাথে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বজায় রেখেছিল।
ইতিমধ্যেই সুপরিকল্পিত প্রতœতাত্ত্বিক উৎখনন এর মাধ্যমে প্রথম আবেষ্টনীর ভিতরে ৩টি, দ্বিতীয় আবেষ্টনীর ভিতরে ৩টি এবং তৃতীয় আবেষ্টনীর ভিতরে ২টি স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ আবিস্কৃত হয়েছে। বর্তমানে ভিতরগড় প্রতœস্থলের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত তালমা ও শালমারা নদী ও প্রাচীন দশটি দীঘি ভিতরগড় প্রতœস্থলের সৌন্দর্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। মহারাজার দীঘি, ফুলপুকুরী, কোদাল ধোয়া, মলানী, বাঘপুকুরী, ঝলঝলী নামে পরিচিত প্রাচীন এই দীঘি গুলিকে ঘিরে রচিত হয়েছে অসংখ্য কিংবদন্তী। এই দীঘি গুলির মধ্যে মহারাজার দিঘী সর্ববৃহৎ। স্থানীয় জনশ্র“তি মতে, পৃথু রাজা কীচক নামে অসাধু এবং নি¤œ বর্ণের জনগোষ্ঠী দ্বারা আক্রান্ত হলে নিজ পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষার্থে পরিবার পরিজনসহ এই দীঘিতে আত্মহত্যা করেন। এর ফলে পৃথুু রাজার রাজত্বের অবসান ঘটে।
কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এসব প্রতœসম্পদ অবহেলা আর উদাসীনতার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে। ভিতরগড় দূর্গনগরীর অমূল্য প্রতœসম্পদ ও বহু প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন স্থানীয় মানুষের হাতে বিলীন হওয়ার পথে। ভিতরগড় প্রতœসম্পদের বিশাল ভান্ডর হলেও কুরাকীর্তি আইনের আওতায় সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়নি।
স্থানীয় অধিবাসী, স্যালিলান টি এস্টেট ও এসিআই গোদরেজ পোল্ট্রী ফার্মসহ কয়েকটি কোম্পানির হাত থেকে ভিতরগড়কে রক্ষা করার জন্য ‘হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’র পক্ষে ভিতরগড় রক্ষায় নির্দেশনা চেয়ে ২০১১ সালের ১৪ জুন উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন অ্যাড. মনজিল মোরশেদ। রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ভিতরগড় দূর্গনগরীকে কেন প্রতœতাত্ত্বিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হবে না মর্মে একটি রুল জারি করেন আদালত। একই সাথে ভিতরগড় প্রতœ সীমার ২৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সব ধরণের নির্মাণ কাজ বন্ধ, স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি ওই এলাকায় সব ধরণের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের উপর নজরদারি বৃদ্ধির জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু আদালতের আদেশ অমান্য করে প্রশাসনের নাকের ডগার সামনে দিয়েই তৈরি হয়েছে টোকাপাড়া বিজিবি ক্যাম্প, গড়ে ওঠেছে স্যালিলান টি এস্টেটসহ প্রতœ সম্পদ ধ্বংসকারী একাধিক চা বাগান, এছাড়াও মাজার, দোকানপাটসহ নতুন নতুন স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। স্থানীয় অসচেতন ব্যক্তিরা দূর্গনগরীর আবেষ্টনী কেটে মূল্যবান প্রতœসম্পদ নষ্ট করে জমি তৈরি করছে। নতুন আরেক সমস্যার নাম পাথর উত্তোলন। সমতল ভূমি অপরিকল্পিতভাবে খনন করার মাধ্যমে নষ্ট হচ্ছে অসংখ্য প্রতœসম্পদ।
এ বিষয়ে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন জানান, আমরা ভিতরগড়ের প্রতœসম্পদ রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে শহর থেকে দূরে হওয়ায় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আমাদের সমস্যায় পড়তে হয়। তবে শুধু প্রশাসনের একার পক্ষে এটি সংরক্ষণ সম্ভব নয়। স্থানীয় জনগণের সচেতনতাই পারে ভিতরগড়কে রক্ষা করতে। তিনি আরও জানান, সরকার যদি ভিতরগড়কে পুরাকীর্তি প্রকল্প হিসেবে ঘোষণা করে এবং একজন প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকর্তা নিয়োগ করে তাহলে এই প্রতœসম্পদকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। তবে আদালতের নির্দেশ অমান্য করে গড়ে ওঠা ওই সকল স্থাপনাগুলোর ব্যাপারে শিঘ্রই ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেও তিনি জানান।
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) অধ্যাপক ও ভিতরগড় খনন কাজের উদ্যোক্তা ড. শাহনাজ হুসনে জাহান বলেন, অপার সম্ভাবনাময় এই ভিতরগড় দূর্গনগরী শুধু বাংলাদেশ নয় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ইতিহাস নির্মাণে প্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক উৎস সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরুত্ব বহন করে। পর্যটন শিল্পের জন্য ভিতরগড় প্রতœস্থল হতে পারে বাংলাদেশের প্রতœ নিদর্শনের এক বিশাল ভান্ডার। আক্ষেপ করে তিনি আরও বলেন, ব্যাপক সম্ভাবনাময়ী ও ইতিহাস ঐতিহ্যের এই প্রত্নস্থল ক্রমে ক্রমে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মানা হচ্ছে না আদালতের নির্দেশ। স্থানীয় প্রশাসনের আন্তরিকতার অভাবে ভিতরগড় প্রতœ সীমায় প্রতিনিয়ন গড়ে উঠছে একাধিক প্রতœসম্পদ ধ্বংসকারী স্থাপনা। তিনি অবিলম্বে সরকারের কাছে ভিতরগড়ের প্রতœসম্পদ রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে এবং ভিতরগড়কে হ্যারিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণার দাবি জানান।
২৮, জুলাই, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস