সুভাষ চৌধুরী: সাতক্ষীরার তালা উপজেলার দাদপুর গ্রামের আবদুল গফফার খান। এলাকায় নানা নামে পরিচিত তিনি। কেউ বলেন পাকা চোর, কেউ বলেন অজ্ঞান পার্টির লিডার, আবার কেউবা বলেন ‘জাদুকর’। ৫০ ছুঁই ছুঁই এ জীবনে বিয়ে করেছেন ৪১টি। তবে এখন ঘরে আছেন একজন। অন্যরা হয় ভিন্ন সংসারে চলে গেছেন, না হয় মারা গেছেন। তবে সবার নাম মনে নেই গফফার খানের। বলেন, ‘কখন কোথায়, কাকে কীভাবে বিয়ে করেছি, সে কী আর মনে রাখা যায়।’
বিয়ের কোনো কাবিননামা আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, ‘কাবিননামা দিয়ে কী করব। বিয়ে হয়েছে দুইজনের মতে। দুই-একটি কাবিননামা থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেই।’ ছিপছিপে চেহারার আবদুল গফফার খান এখন অসুস্থ। বাড়িতেই থাকেন। হাতে-পায়ে আঘাতের দাগ। অনেক দায়-দেনা। দিতে পারেন না। পাওনাদাররা তার পিছু লেগে থাকে।
শনিবার সকালে দাদপুর গ্রামে পৌঁছাতেই দেখা মিলল বেশ কয়েকজন পাওনাদারের। চেয়ারে বসে মুখে সিগারেট নিয়ে গফফার খান বলেন, ‘আমার কাছে তারা টাকা পাবে। কিন্তু টাকা দেয়ার সাধ্য নেই।’
এলাকায় প্রচার রয়েছে গফফার জাদু জানেন। মন্ত্রও জানেন। ইচ্ছা করলে হাতের ঘড়ি, আংটি একমন্ত্রে উড়িয়ে দিতে পারেন। গ্রামের কয়েকজন জানান, গফফার একটি অজ্ঞান পার্টি চালায়। যে কোনো মানুষের সঙ্গে খাতির জমিয়ে তার বাড়িতে পৌঁছে খাবারের সঙ্গে ওষুধ মিশিয়ে বাড়ির লোকজনদের অজ্ঞান করে সবকিছু হাতিয়ে নেয়।
এ নিয়ে বেশ কয়েকবার গণপিটুনিরও শিকার হয়েছেন তিনি। এক বছর আগে তালার ইসলামকাঠিতে একই ঘটনা ঘটাতে গিয়ে গণপিটুনি খেয়ে আহত হয়ে প্রায় পঙ্গুত্ব বরণ করেন গফফার। তবে এ বিষয়ে গফফারের বক্তব্য হল, ‘ষড়যন্ত্র মূলকভাবে আমার ভাগ্নে আবু সাঈদ আমাকে মারধর করেছে।’
কয়টি বিয়ে করেছেন জানতে চাইলে গফফার খান জানান, ‘তিন-চারটি করেছি আর কি। কিছুক্ষণ পর বলেন, ৮টি বিয়ে করেছি।’ আপনি অনেক বিয়ে করেছেন এমন প্রচার কেন জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি ৪১টি বিয়ে করেছি, কিন্তু এসব জেনে আপনি কী করবেন।’
৩০ বছর আগে তালার ইসলামকাঠির নওশের আলীর মেয়ে মঞ্জুয়ারাকে বিয়ে করেন গফফার খান। সেই স্ত্রী এখন আর বেঁচে নেই। শেষদিকে যশোরের মনিরামপুরের হাসাডাঙা গ্রামের কোরবান আলীর মেয়ে রওশন আরাকে বিয়ে করেন। পরে কেশবপুর উপজেলার মধ্যকূল গ্রামের জয়নাল হোসেনের মেয়ে আছিয়াকে বিয়ে করেন।
আছিয়ার ঘরে এক প্রতিবন্ধী ছেলে আছে। নাম জাহাঙ্গীর (৩২)। এর আগে নিজ গ্রামের শমসের খার মেয়ে খুকি বিবিবে বিয়ে করেন গফফার খান। খুকির ছেলে আবদুস সেলিম এখন বরিশালে দিনমজুরের কাজ করেন। ঘরে এখন যে স্ত্রী আছেন তার নাম আছিয়া। এ ঘরে একটি মেয়ে আছে।
গ্রামের লোকজন জানান, গফফার খান ১-২ মাস অন্তর একটি বিয়ে করে বাড়িতে বউ নিয়ে আসেন। কিছুদিন থেকে আবার দু’জন উধাও হয়ে যান। এরপর দেখা যায়, আবারও কোনো মহিলাকে বিয়ে করে এনেছেন। কিছুদিনের মধ্যে সেও উধাও। তাদের দাবি, গফফার খান জাদুকরী বিদ্যা জানে। সে ইচ্ছা করলে বাড়ির সম্পদ তো দূরের কথা, একজন ব্যক্তিকেও নিখোঁজ করে দিতে পারে। আর এ ভয়ে গফফার খানের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলতে চায় না।
গ্রামের বৃদ্ধা রিজিয়া খাতুন ও সেলিনা বেগম জানান, গফফার খানের অগণিত বিয়ে। এটা জেনেও তাকে কেউ কিছু বলে না। এর কারণ, সে একটি অজ্ঞান পার্টির পরিচালক এবং জাদুকর। তার ক্ষতি করলে সেও ক্ষতি করে ফেলবে।
কুমিরা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান দাদপুর গ্রামের আবদুর রশিদ বলেন, তিন বছর আগে গফফার খান আমার বাড়িতে ঢুকে খাবারের সঙ্গে ওষুধ মিশিয়ে আমাকে ও আমার স্ত্রীকে অজ্ঞান করে ঘরের সবকিছু নিয়ে যায়। ইসলামকাঠি হাইস্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক শামসুর রহমান জানান, গফফার খান তার বাড়িতে এক বছর আগে এসে পরিচয় পর্ব সেরে কৌশলে রান্নাঘরে ঢুকে রান্না করা মাংসে ওষুধ মিশিয়ে দেয়।
এ মাংস খেয়ে তার স্ত্রী তহমিনা খাতুন ও প্রতিবেশী বেল্লাল ও ইসমাইল জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এ সুযোগে গফফার ঘরে ঢুকে টাকা-পয়সা সোনা-গয়না নিতে যাওয়ার সময় ধরা পড়ে। মারধর করে তাকে আটকে রাখা হয়। খবর পেয়ে পুলিশ এসে তাকে নিয়ে যায়।
এ পর্যন্ত ১৭ বার জেলে গেছেন গফফার খান। অথচ একবারমাত্র ৯১ দিন ছিলেন। আর বাকি সময় মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে বেরিয়ে আসেন। এ প্রসঙ্গে গ্রামের লোকজন বলেন, জেলখানার মধ্যেও তিনি জাদুকরী বিদ্যা ফলিয়ে সবার সঙ্গে প্রতারণা করে থাকেন। কীভাবে এত দ্রুত জামিন পান, তা নিয়েও তারা বিস্মিত। গ্রামে অনেকবার সালিশ হয়েছে গফফার খানকে নিয়ে। কিন্তু কোনো সালিশ কার্যকর হয়নি।
কুমিরা ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আজিজুল ইসলাম বলেন, গফফার খান একজন পাকা চোর ও প্রতারক। মানুষকে অজ্ঞান করে, চুরি-ডাকাতি করে সম্পদ লুটপাট করে সে। এছাড়া জাল টাকার ব্যবসাও করে। তিনি বলেন, সে বারবার জেলে যায়, বারবার ফিরে আসে। এলাকার ইউপি সদস্য দাদপুর গ্রামের লালু চৌধুরী জানান, ‘গফফার খান অনেক নারীর সর্বনাশ করেছে। এখন সে অসুস্থ। তাকে ভালো পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি আমরা। প্রতারণা করে অনেক টাকা কামাই করলেও গফফার খান তা রাখতে পারেনি।’
গফফার খানের স্ত্রী আছিয়া খাতুন ও প্রতিবন্ধী ছেলে জাহাঙ্গীর জানান, তারা তাকে (গাফফার) অসৎ পথ থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তিনি কোনো কথা শোনেন না। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানাতে চাইলে গফফার খান বলেন, ‘বহু বিয়ে করলেও কাউকে নিজে বঞ্চিত করিনি। আগে যাই করি না কেন, এখন ভালো হয়ে গেছি। এখন শুধু দেনার টাকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’-যুগান্তর
২৭ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ