জাহিদ সুমন, শ্যামনগর (সাতক্ষীরা) থেকে : মন দিয়েই ভালোবেসেছিল শিখা (ছদ্মনাম)। কখনো বুঝেনি প্রেমিক তার সঙ্গে ছলনা করছে। সরল বিশ্বাসে মন সঁপে দিয়েছিল বুলবুলকে। প্রেমের অভিনয় করে বুলবুল তাকে টেনে নেয় নিজের কাছে। বুলবুলের হাত ধরে পালিয়ে যায় অনেক দূর। সে হাত ধরা যে ছিল তার ভুল, এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে। আর সেই প্রেমের আগুনে পুড়ে ছাই শিখা।
দু’বছর আগে বুলবুলের নজরে পড়ে শিখা। তখন সে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। শিখাদের গ্রামে বেড়াতে এসে বুলবুল ফাঁদ পাতে প্রেমের। সহজ সরল শিখা সেই ফাঁদে পা দেয়। সে জানতো না বুলবুল একজন নারী পাচারকারী। যখন জানতে পারে তখন তার আর কিছুই করার ছিল না। কারণ তখন স্টিয়ারিং বুলবুলের হাতে। বুলবুল ও তার সহযোগীরা শিখাকে আরো কয়েকজন তরুণীর সঙ্গে সিঙ্গাপুর পাচার করে দেয়। সেখানে ৮ থেকে ৯ মাস শিখার ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। বাধ্য করা হয় হোটেলে ‘ড্যান্সার’ হিসেবে কাজ করতে। অসহনীয় সে জীবন সইতে না পেরে পালিয়ে আসে দেশে। কিন্তু পালিয়ে এসেও রক্ষা হয়নি। বুলবুল চক্র তার পিছু নেয়। ফের তাকে নিয়ে নেয় তাদের কব্জায়। সেখানেও নির্যাতন চালানো হয় তার ওপর। এখন শিখা মৃত্যুপথযাত্রী।
পাচারকারীদের বর্বরতায় প্রাণবন্ত শিখা আজ কঙ্কালসার। হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। ঘটনাটি সাতক্ষীরার শ্যামনগর ঘোলা গ্রামের। শিখার পিতা জানান, অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিল সে। ২০১৪ সালের অক্টোবরে সে আকস্মিক বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যায়। পরে জানতে পারেন প্রতিবেশী আব্দুর রউফ সরদারের বাড়িতে বেড়াতে আসা তার স্ত্রী’র নিকট আত্মীয় খুলনার দৌলতপুর এলাকার বুলবুল হোসেন ও তার চার সহযোগী তার মেয়েকে ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে। প্রেমের সম্পর্কের জেরে মেয়ে ঘর ছেড়েছে শুনে দীর্ঘদিন পর্যন্ত তারা রাগে-ক্ষোভে শিখার কোনো খোঁজখবর নেয়নি।
তিনি জানান, প্রায় ৯/১০ মাস পর সিঙ্গাপুর থেকে মেয়ের ফোন পেয়ে তারা নিশ্চিত হন শিখা পাচার চক্রের ফাঁদে পড়েছে। এসময় প্রতিবেশী আব্দুর রউফ ও তার স্ত্রী’র ওপর চাপ সৃষ্টি করা হলে নানা টালবাহানার পর তাদের জানানো হয় সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার পর শিখা তাদেরই নিকট আত্মীয় বুলবুল হোসেনের সঙ্গে বিয়ে করে ঘর সংসার করছে।
শিখার ভাই বলেন, শিখা সিঙ্গাপুরে পাচার হওয়া অপর কিশোরী হাফিসা (ছদ্মনাম) খাতুনের সঙ্গে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। তবে লজ্জায় দেশে ফিরে সরাসরি বাড়িতে না এসে নাফিসার সঙ্গে টাঙ্গাইলে তাদের বাড়িতে উঠে। এসময় নিজেদের অপকর্ম প্রকাশ্যে চলে আসার শঙ্কায় বুলবুল ও তার সহযোগীরা শিখাকে কৌশলে হাফিসার বাড়ি থেকে দ্বিতীয়বারের মতো নিজেদের কব্জায় নিয়ে যায়।
শিখার ভাই জানান, হাফিসাদের বাড়ি থেকে নিয়ে শিখাকে দীর্ঘদিন আটকে রেখে বুলবুল ও তার সহযোগীরা শিখার ওপর পাশবিক ও শারীরিক নির্যাতন চালায়। এক পর্যায়ে তার বোন আত্মহত্যার চেষ্টা করে মৃত্যু শয্যায় বলে শিখার বাড়িতে খবর পাঠায়।
তারা হাসপাতালে গিয়ে দেখতে পান তার বোন কঙ্কালসার হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। এমনকি তার বোন তাদের সঙ্গে কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। চরম পাশবিক ও শারীরিক নির্যাতন করে তাকে এমন অবস্থায় নেয়া হয়েছে দাবি করে শিখার ভাই বলেন, তার বোনকে সিঙ্গাপুর নিয়ে অমর্যাদাকর কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে। দেশে ফেরার পর মুখোশ উন্মোচনের ভয়ে একই চক্র দ্বিতীয়বার হাফিসাদের বাড়ি থেকে নিয়েও তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। শেষ পর্যন্ত প্রতিবেশী আব্দুর রউফ সরদার ও তার স্ত্রীকে রক্ষা করতে বুলবুল ও তার সহযোগীরা মিথ্যে বিয়ে নাটক সাজিয়ে শিখার সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ করতে না দিয়েও দুই লাখ বিশ হাজার টাকা নেয় অটোরিকশা কেনার কথা বলে।
শিখার সঙ্গে সিঙ্গাপুর থেকে পালিয়ে আসা হাফিসা জানান, সিঙ্গাপুরে পরিচয়ের সময় শিখা তাকে বলেছিল যে, বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে বুলবুল হোসেন তাকে বাড়ি থেকে ফুসলিয়ে নেয়। পরবর্তীতে তাকে কৌশলে সিঙ্গাপুরে পাঠিয়ে ‘ড্যান্সারে’র কাজ করতে বাধ্য করে। শিখা সিঙ্গাপুর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে তার সাহায্য চেয়েছিল। হাফিসা জানায়, শিখা তাকে বলেছিল বাড়ি থেকে নিয়ে আসার পর নিজের ভিসা জটিলতার কথা বলে শিখাকে আগে সিঙ্গাপুর পাঠায় বুলবুল।
এ ব্যাপারে আব্দুর রউফ সরদারের স্ত্রী ইসমত জাহান বলেন, তার ভাইয়ের বন্ধু হিসেবে তাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল বুলবুলের। প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করার পর শিখার সম্মতিতে তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয় বলে দাবি করেন তিনি। বিয়ে করা হলে শিখার এমন অবস্থায় বুলবুল পলাতক কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন “একটা অসুস্থ মেয়েকে কতদিন দেখতে হবে”। এমজমিন
২৯ জানুয়ারি ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসবি