শনিবার, ১৩ মে, ২০১৭, ১১:৪৮:৩৯

এই মা বাঘ ভয় পান না

এই মা বাঘ ভয় পান না

সাতক্ষীরা: বাবা ও স্বামীকে হারিয়েছেন বনেই। তার পরও আশ্রয় তাঁর বন। সুন্দরবনে মাছ ধরে ছেলে ও মেয়েকে বড় করেছেন। মাছ ধরার নৌকায় বসেই মাহবুবর রহমান সুমনকে নিজের জীবন-সংগ্রামের গল্প শোনালেন আন্দারী বালা

কত সালে জন্ম মনে নেই। তবে মনে আছে,  জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই বাবার সঙ্গে বনে গেছেন মাছ ধরতে। তারপর কৈশোরেই বাবাকে হারিয়েছেন। বাবা বেরিয়েছিলেন দিনে দিনে। কিন্তু রাতে আর ঘরে ফেরেননি। খবর শুনেছিলেন বাবার বন্ধুর কাছ থেকে—বাবাকে বাঘে ধরেছে। অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় আন্দারী বালার। বিয়ের পর ঠিকানা বদলালেও পেশা বদলায়নি আন্দারীর। স্বামী গীরিন্দ্র মণ্ডলের সঙ্গেও বন পাড়ি দিতেন। মাছ ধরতেন।   ঘরে দুই সন্তান আসে। সন্তানরা উপযুক্ত হওয়ার আগেই স্বামীকেও হারান। সেই একই ঘটনা, বাঘে ধরে নিয়ে গেছে। আন্দারীর চোখে অন্ধকার নেমে আসে। দিশাহারা হয়ে মাছ ধরার নৌকাটি বিক্রি করে দেন। স্বামীর ছিল ওটিই একমাত্র সম্বল।

বাড়ি জেলেখালী
সাতক্ষীরা জেলার মুন্সীগঞ্জের বনলাগোয়া গ্রাম জেলেখালী। স্বামীকে যখন হারান তখন আন্দারীর কোলে দুই বছরের এক কন্যাসন্তান। ছেলেটার বয়স সাত। আন্দারীই একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ। কাজের সন্ধানে আন্দারী মেয়ে কোলে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে থাকেন। ঝিয়ের কাজ দু-চার ঘরে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাতে সংসার চলছিল না। তাই ফিরে গেলেন বনে। সেই বনে, যেটি তাঁর বাবা ও স্বামীকে কেড়ে নিয়েছে। খুব রাগ আন্দারীর বনের ওপর।   কিন্তু উপায়ই বা কী। তখন মেয়েকে সকাল সকাল খাইয়ে দিতেন। তারপর গাঁয়ের আরেক বাড়িতে মেয়েকে রেখে চলে যেতেন বনে। বিকেলে ফিরে আবার মেয়েটাকে খাওয়াতে বসতেন। এভাবেই চলে যাচ্ছিল জীবন। তবে তখন ছেলেটা সঙ্গ দিয়েছে অনেক অনেক দিন। বলতে গেলে বনে সে-ই মাকে পরি (পাহারা) দিয়েছে। আন্দারীর খুব ইচ্ছা ছিল ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া করানোর। বলছিলেন, ‘আমি নিজের নাম লিখতে পারি না, তাই খুব ইচ্ছা ছিল ছেলে-মেয়েরা যেন নিজের নাম লিখতে পারে। ’ কিন্তু  গ্রামে স্কুল ছিল না। তাই ওদের আর পড়াশোনা হয়নি। তবে আন্দারী অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে রাখতেন। মেয়েটার বিয়ে দিয়েছেন ওই জমানো টাকাতেই। ছেলের বিয়েরও কিছু খরচ দিয়েছেন আন্দারী। আন্দারী কিন্তু অদম্য মানুষ। ছেলে-মেয়েকে পড়াতে না পারার কষ্ট ভুলতে পারেননি। এখন ছেলের মেয়েকে কিন্তু পড়াচ্ছেন। নাতনির পড়াশোনার যাবতীয় খরচ আন্দারী বহন করেন। বলছিলেন, ‘এখন আমার ছেলের  মেয়েকে আমার খরচে পড়ালেখা শেখাচ্ছি। ছেলেকে পারিনি, তাই ছেলের মেয়েকে শিখিয়ে সেই ইচ্ছা পূরণ করছি। সে এখন ক্লাস টুতে পড়ে। ’

নদী তীরে অপেক্ষা
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে এক কিলোমিটার পথ পায়ে  হেঁটে পৌঁছান মালঞ্চ নদীর তীরে। আন্দারীর নিজের নৌকা নেই। অন্য জেলেদের নৌকাই ভরসা। মালঞ্চের তীরে বসে তাই প্রহর গোনেন—কখন একটি নৌকা আসে। সব মাঝির নৌকায় জায়গাও থাকে না। তাই ফিরিয়েও দেন কেউ কেউ। বলছিলেন, ‘নিজের  নৌকা না থাকায় আমাকে বনে যেতে অনেক সময় নদীর পাড়ে অপেক্ষা করতে হয়। যখন কেউ সদয় হয়ে নৌকায় তুলে নেয় তখনই আমার বনে যাওয়া হয়। ’ আন্দারী বনে মাছ ধরেন, কাঁকড়াও। সন্ধ্যায় শহরে সেই মাছ বা কাঁকড়া বিক্রি করে বাজার করেন। তারপর ঘরে ফিরে রাঁধতে বসেন। কত টাকা আয় করেন দিনে জানতে চাইলে আন্দারী বলেন, ‘অনেক দিন কিন্তু বেচাবিক্রি একদম মন্দা যায়। তাই কোনো দিন ৫০ টাকায়ই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। অনেক দিন আবার ৪০০ টাকাও আয় হয়। ’

ভয় পান না আন্দারী বালা
জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই বনে পাড়ি দিয়ে চলেছেন আন্দারী। বনে পাঁচবার তাঁর বাঘ দেখা হয়ে গেছে এ পর্যন্ত। কিন্তু ভয় পেয়ে ঘরে বসে থাকেন না। তাহলে যে জীবন চলে না।-কালের কণ্ঠ
এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে