নিউজ ডেস্ক: সেহেরির পর ফজরের আজানের সাথে সাথে মুক্তামণির ঘুম ভেঙে যায়। সকালে মন সায় দিলে কিছু মুখে দেয়, না হলে যন্ত্রণার সাথে জীবনের নীরব যুদ্ধ করে ফের আরো একটু ঘুমানোর চেষ্টা করে সে।
গতকালও ব্যতিক্রম হয়নি তার। একই সময় ঘুম ভাঙে। তবে অন্য দিনের সাথে আজ সকালের নিয়মে ছন্দপতন হয়। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে চিৎকার করে বাড়ির সবাইকে কাছে ডাকে মুক্তামণি। দৌড় ঝাঁপ করে বাড়ির সবাই ছুটে আসে তার পাশে।
প্রিয় মুখগুলো এক পলক দেখে নেয় মুক্তামণি। তারপর মাকে পানি খাওয়ার কথা বলে এক গ্লাস পানি আনতে বলে সে। বাবা দাঁড়িয়ে থাকেন তার মাথার কাছে।
পানি নিয়ে আসার পর বাবার হাতে পানির গ্লাস দিয়ে সবাইকে ঘর থেকে বাইরে যেতে বলে। ঘরের মধ্যে থাকা বাবাকে বলে ‘আমার ঘুম পাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে পানি খাবো। তোমরা তোমাদের কাজে যাও’। মুক্তা ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যেই সে চলে যায় পৃথিবীর মায়ালোক ছেড়ে।
বুধবার সকালে মুক্তামণির বাবা ইব্রাহিম হোসেন ক্রন্দনরত অবস্থায় এসব কথা জানান।
মুক্তামণির চাচি খাদিজা খাতুন বিলাপ করছিলেন পাশের রান্নাঘরের বারান্দায় বসে। তিনি শোকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন বার বার। জ্ঞান ফিরে স্বজনদের তিনি বলছিলেন, ঢাকা থেকে উন্নত চিকিৎসা শেষে এক মাসের ছুটিতে বাড়ি ফিরে মুক্তামণি তাকে বলেছিল ‘ভাগ্য ভালো চাচি। আমার কথা প্রধানমন্ত্রী জানতে পেরেছেন। না হলে হয়তো এতদিনে মরেই যেতাম’।
মুক্তাকে দেখতে আসা শত শত মানুষ জানে চাচির বলা এসব এখন কথার কথা। সে বেঁচে থাকলে ভালো হতো। সবাইকে কাঁদিয়ে সে এখন না ফেরার দেশে। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়াইয়ে যমদূতেরই জয় হয়েছে। রক্তনালীতে টিউমার আক্রমণ করায় সাতক্ষীরার বহুল আলোচিত মুক্তামণি মৃত্যুর কাছে শেষ পর্যন্ত পরাজয় বরণ করেছে।
মুক্তার মৃত্যুর খবর পেয়ে তাকে শেষবারের মতো দেখতে আসেন সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার মো. সজ্জাদুর রহমান, উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবু, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. শওকত হোসেন, জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা।
বুধবার সকাল ৮টার দিকে মুক্তামণি তার নিজ বাড়ি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কামারবায়সা গ্রামে মারা যায়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সাতক্ষীরার মানুষ শোকাতুর হয়ে ওঠে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা চলছিল।
প্রসঙ্গত, কামারবায়সা গ্রামের মুদি দোকানী ইব্রাহিম হোসেনের মেয়ে ১৩ বছরের মুক্তামণির হাতে দেড় বছর বয়সে একটি মার্বেলের মতো গোটা দেখা যায়। সেটি পরে বড় আকার ধারণ করে। কয়েক বছর আগে থেকে তার আক্রান্ত ডান হাতটি একটি গাছের ডালের আকার ধারণ করে পচে উঠতে থাকে।
২০১৭ সালের জুলাই মাসের প্রথম দিকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে মুক্তামণির রোগের কথা প্রচারিত হয়। ওই বছরের ১১ জুলাই সরকারি উদ্যোগে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নেওয়া হয়। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা চলছিল।
টানা ছয় মাসের চিকিৎসায় খানিকটা উন্নতি হওয়ায় ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর মুক্তামণিকে এক মাসের ছুটিতে বাড়ি পাঠানো হয়। বাড়িতে আসার পর থেকে তার অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যেতে থাকে। শরীরে নতুন করে পচন ধরে। তাতে পোকা জন্মায়। এমনকি রক্তও ঝরতে থাকে।
মুক্তামণির বাবা ইব্রাহিম হোসেন বলেন, বুধবার সকাল সোয়া ৮টার দিকে মুক্তামণি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। তার মৃত্যুতে সাতক্ষীরা জেলাসহ দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। জোহরের নামাজের পর জানাজা শেষে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে মুক্তামণিকে।
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস