সিরাজগঞ্জ : ‘বাবারে আমার ব্যাটা আর তার বউডাকে জেএমবি বইলা পুলিশ গত মাসে ধইরা নিয়া গেল। এহুন হুনতাছি শুধু ব্যাটার বউয়ের কথা। তালি আমার ব্যাটাডা গেল কোনে। আমার ব্যাটা ও ব্যাটার বউ ছাড়া আরও চারজনকে ধইরা নিয়া গেছে হুনলাম। হুনছিলাম এ গিরাম থইন পুলিশ ছয়জনকে ধইরছে। কিন্তু এক মাস পর হুনতাছি চারজন। তালি আমার ব্যাটাসহ বাকি দু’জন গেল কোনে।’
এ মন্তব্য করেছেন সিরাজগঞ্জের কাজিপুরের গান্ধাইল ইউনিয়নের বরইতলা গ্রামের লোকমান হোসেন। তার ছেলে রফিকুল ও ছেলের স্ত্রী রাজিয়া বেগমকে জেএমবি’র কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে এক মাস আগে পুলিশ আটক করেছে বলে দাবি করেন ক্যানসারে আক্রান্ত এই ব
সন্দেহভাজন জেএমবি নেতা ফরিদুল ইসলাম ছাড়াও বরইতলা গ্রামে নিখোঁজ রয়েছে স্বর্ণকার আব্দুল আজিজের কলেজ পড়ুয়া মেয়ে আকলিমা খাতুন। তারা এখন কোথায় আছে, এ প্রশ্ন শুধু রফিকুলের বাবার নয়, এ গ্রামের সবারই। তারা আটক নাকি নিখোঁজ,তা নিয়েও নানা রহস্য তৈরি হয়েছে। ভয়ে কেউই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মুখোমুখি হতে সাহস পাচ্ছেন না।
এদিকে, ডিবি পুলিশ গত ৪ সেপ্টেম্বর ভোররাত সাড়ে ৩টার দিকে বরইতলা গ্রামে অভিযান চালায়। সিরাজগঞ্জ ডিবির সেকেন্ড অফিসার উপ-পরিদর্শক রওশন আলী ও উপ-পরিদর্শক ইয়াসির আরাফাত এতে নেতৃত্ব দেন।
অভিযানে সিরাজগঞ্জ পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে ডিপ্লোমা করা জেএমবির সন্দেহভাজন শীর্ষ নেতা ফরিদুল ইসলামের মা ফুলেরা বেগম (৪৫), তার বোন শাকিলা খাতুন (১৮) ও সালমা খাতুন (১৬)এবং প্রতিবেশী কাঠমিস্ত্রি রফিকুল ইসলামের স্ত্রী রাজিয়া বেগম (৩৫)-কে আটক করেছে বলে গোয়েন্দা পুলিশের দাবি।। তাদের বাড়ি থেকে কিছু জিহাদি বই ও কম্পিউটার জব্দ করা হয়।
সোমবার দুপুরে প্রেস বিফিং-এ পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, ‘আটক চার নারীই জেএমবির ফিদায়ী বা আত্মঘাতী ইউনিটের সদস্য বলে স্বীকার করেছে।’
অন্যদিকে,বরইতলা গ্রামে জেএমবির সন্দেহভাজন পলাতক নেতা ফরিদুলের আরও অনেক অনুসারী রয়েছে বলে সন্দেহ করছে পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর খোঁজাখুঁজির কারণে জেএমবির সন্দেহভাজন শীর্ষ নেতা ফরিদুল ইসলাম গত এক বছর ধরে নিখোঁজ। নিখোঁজ রয়েছে ফরিদুলের বাবা কাচাঁমাল ব্যবসায়ী আবু সাঈদ (৫৫), প্রতিবেশী কাঠ মিস্ত্রি রফিকুল ইসলাম (৪৫), কর্মকার আব্দুল আজিজের বড় মেয়ে কাজিপুর এম. মনসুর আলী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স পড়ুয়া ছাত্রী আকলিমা খাতুন (২৩)।
ডিবির অভিযানের পর ফরিদুলের ছোট বোন সুমাইয়া খাতুনকে (৮) তার নানা-নানি বগুড়ার ধুনট উপজেলার ভবনগাঁতীর নিজ বাড়িতে নিয়ে গেছেন। অভিযানের পর নিখোঁজ কাঠমিস্ত্রি রফিকুলের তিন ভাই ভ্যানচালক শফিকুল, তাঁত শ্রমিক রাসেল ও শরিফ আত্মগোপন করেছে। এছাড়া নিখোঁজ আছিয়ার বাবা কর্মকার আব্দুল আজিজ ও তার কলেজ পড়ুয়া ছেলে মমিন এবং স্কুল পড়ুয়া ছেলে মারুফও গা-ঢাকা দিয়েছে বলে জানা গেছে।
মঙ্গলবার দুপুরে ফরিদুলের বাড়িতে গিয়ে কাউকেই পাওয়া যায়নি। বাড়ির তিনটি ঘরেই তালা নেই। প্রতিটি ঘরে আসবাবপত্র ও গৃহস্থালির জিনিসপত্র কিছুটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
পুলিশের হাতে আটক ফুলেরা খাতুন, শাকিলা, সালমা ও সন্দেহভাজন নিখোঁজ জেএমবি নেতা ফরিদুলের বাড়ি
প্রতিবেশীরা জানান, গত এক মাসের মধ্যে আইন -শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন দফায় দফায় ওই গ্রাম থেকে ছয়জনকে ধরে নিয়ে গেছে। তারা হলেন, ফরিদুলের মা ফুলেরা বেগম, তার বোন শাকিলা ও সালমা এবং প্রতিবেশী কাঠমিস্ত্রি রফিকুল ও তার স্ত্রী রাজিয়া বেগম এবং কর্মকার আব্দুল আজিজের মেয়ে আকলিমা খাতুন। ফরিদুলের বাবা ও ছোট ভাইসহ বাকিরা ওই ঘটনার পর গা-ঢাকা দিয়েছেন। গত কোরবানির ঈদের পর থেকে নিখোঁজ রয়েছে ফরিদুল।
কাঠমিস্ত্রি রফিকুলের বাড়িতে গেলে তার সৎ মা জোহরা বেগম জানান, তার ছেলে রফিকুল ও ছেলের বউ রাজিয়া খাতুনকে প্রায় এক মাস আগে কে বা কারা ধরে নিয়ে গেছে, তা তারা জানেন না। ঘটনার পর ভয়ে অন্যান্য ছেলেরাও পালিয়ে বেড়াচ্ছে। রফিকুলের ১৪/১৫ বছরের স্কুল পড়ুয়া ছেলে রাজুও পুলিশের ভয়ে বাড়িতে নেই বলে জানান তিনি।
গ্রামবাসী জানায়, তারা কখনও ঝগড়া-বিবাদ করেনি। ভেতরে ভেতরে তারা নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হলেও বিষয়টি জানে না কেউই।
অভিযানের নেতৃত্বদানকারী ডিবি পুলিশের সেকেন্ড অফিসার উপ-পরিদর্শক রওশন আলী মঙ্গলবার দুপুরে জানান, ‘সোমবার ভোরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামাআতুল মুজাহিদীন অব বাংলাদেশের (জেএমবি) ‘ফিদায়ী হিজরত’ বা ‘আত্মঘাতী’ ইউনিটের চার সন্দেহভাজন নারী সদস্যকে বিপুল পরিমাণ জিহাদি বইসহ বরইতলা গ্রাম থেকে আটক করেছে ডিবি পুলিশ।’ এর বাইরে আর কাউকেই তারা গ্রেফতার, বা আটক করেননি বলেও দাবি তার। আর কেউ নিখোঁজ আছে কিনা, সে বিষয়টিও তার জানা নেই।
এদিকে, আটক জেএমবির সন্দেহভাজন নারী সদস্য শাকিলা খাতুন (১৮) ও সালমা খাতুন (১৬) এবং রাজিয়া বেগমকে মঙ্গলবার বিকেলে সিরাজগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নজরুল ইসলামের আদালতে হাজির করা হয়। তারা তিনজনই ১৬৪ ধারায় বিচারকের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে বলে ডিবির কর্মকর্তা রওশন আলী ও কোর্ট পরিদর্শক মো. শহিদুল্লাহ জানান।
ডিবির ওসি মো. ওয়াহেদুজ্জামান বলেন, ‘জেএমবি সম্পৃক্ততার অভিযোগে বরইতলা গ্রাম থেকে এ পর্যন্ত চারজনকে ধরা হলেও ফরিদুলসহ বাকিদেরও খুঁজছে পুলিশ। আশা করি, বাকিরা শিগগিরই ধরা পড়বে।’ -বাংলা ট্রিবিউন
০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম