মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৭, ০১:০২:০৩

আওয়ামী লীগের দুর্গে হানা দিতে চায় বিএনপি

আওয়ামী লীগের দুর্গে হানা দিতে চায় বিএনপি

ইসরাইল হোসেন বাবু, সিরাজগঞ্জ থেকে : আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত সিরাজগঞ্জের উত্তর জনপদের যমুনা নদীবেষ্টিত কাজিপুর উপজেলা। এই উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন, ১টি পৌরসভা এবং সিরাজগঞ্জ সদরের ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে সিরাজগঞ্জ-১ আসন গঠিত। স্বাধীনতার পর থেকে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল এ আসনে নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেনি।

তবে ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে প্রতিবারের বিজয়ী আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে ভোটে যুদ্ধ করেই বিজয় নিশ্চিত করতে হবে বলে বিএনপি নেতাকর্মীদের ধারণা। এ আসনে মহাজোটের শরিক দল জাসদও প্রার্থী দিতে প্রস্তুত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সহচর জাতীয় চার নেতার এক নেতা শহীদ ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলীর জন্মস্থান সিরাজগঞ্জ-১ (কাজিপুর) আসনে।

স্বাধীনতাযুদ্ধে যেমন অসামান্য অবদান রয়েছে তার, তেমনি যত দিন তিনি বেঁচে ছিলেন তত দিন কাজিপুরের মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের হয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তিনি বিজয়ী হয়ে প্রাদেশিক পরিষদের মন্ত্রী হন। ’৭০-র নির্বাচনে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন পান।

মুক্তিযুদ্ধকালে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কারণে মুক্তিযুদ্ধের পরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিপ্লবী সরকারের অর্থমন্ত্রী এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের যোগাযোগমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের উন্নয়নের পাশাপাশি নিজ এলাকার উন্নয়নে ব্যক্তিগত ভূমিকার কারণে তিনি এখনও এলাকাবাসীর কাছে স্মরণীয়।

সে সময় তিনি এ অঞ্চলের মানুষের জন্য চাকরি, দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসন, নদীভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেয়ায় মানুষের অন্তরে ঠাই করে নেন। তার মৃত্যুর পর মেজো ছেলে মোহম্মদ নাসিমকে এ অঞ্চলের মানুষ তার পিতার স্থানে বসিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে মোহাম্মদ নাসিম সিরাজগঞ্জ-১ ও সিরাজগঞ্জ-২ এ ২টি আসন থেকে নির্বাচিত হন। মোহাম্মদ নাসিম সিরাজগঞ্জ-১ আসনটি ছেড়ে দিলে তার বড় ভাই ড. মোহাম্মদ সেলিম উপনির্বাচন করে বিজয়ী হন।

এরপর ২০০১ ও ২০১৪ সালে মোহাম্মদ নাসিম এ আসন থেকে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। ২০০৮ সালে মোহাম্মদ নাসিম মামলাজনিত কারণে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারায় তার ছেলে প্রকৌশলী তানভীর শাকিল জয় নির্বাচিত হন। এ আসনের ইউনিয়ন থেকে মহল্লা পর্যন্ত আওয়ামী রাজনীতির একক আধিপত্য রয়েছে। তবে উপজেলার রাজনীতিতে নেতৃত্ব নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে কোন্দলও রয়েছে। কোন্দলের জেরে এক পক্ষের দ্বারা অপর পক্ষকে লাঞ্ছিত করার ঘটনাও ঘটে। কিন্তু মোহাম্মদ নাসিম ও তার ছেলে জয় শক্ত হাতেই তা মোকাবিলা করে থাকেন।

মোহাম্মাদ নাসিম ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এ আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি কাজিপুরকে নতুনভাবে সাজিয়েছেন তিনি। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিভাগের উন্নয়নের পাশাপাশি এ অঞ্চলের মানুষের দুঃখ লাঘবে নদীভাঙন রোধে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। যমুনা নদীর প্রত্যন্ত ইউনিয়নের গ্রামগুলোয় লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া।

পাকা সড়ক, বৈদ্যুতিক লাইন, সৌরবিদ্যুৎ, স্কুল-কলেজের স্থায়ী ভবনসহ চরাঞ্চলবাসীর জীবনযাত্রায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। প্রতি সপ্তাহে তিনি এলাকায় আসেন এবং নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজনৈতিক ও সরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছেন। এরই মধ্যে সরকারের উন্নয়নে প্রচারণা ও এলাকায় মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনের জন্য নিজের প্রার্থিতার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।

বিএনপি: আওয়ামী লীগের দুর্গ ভাঙতে এ আসনে বিএনপি তাদের মাঠ সাজাতে এবারও হিমশিম খাচ্ছে। এ আসনে বিএনপির রাজনীতি শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। জাতীয় ও আঞ্চলিক আন্দোলন সংগ্রামের প্রভাব এখানে পড়ে না। উপজেলা বিএনপির প্রথমসারির নেতাদের অনুপস্থিতির কারণে এখানে বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল। তবে জেলা বিএনপির নতুন কমিটি ঘোষণার পর এ অঞ্চলে বিএনপির নেতাকর্মীরা কিছুটা উজ্জীবিত।

তবে নেতাকর্মীদের দাবি, ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক আগ্রাসী মনোভাবের কারণে কোনো প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত করতে পারেন না তারা। আগামী নির্বাচনকে ঘিরে দলে নতুন কর্মী সংগ্রহ কার্যক্রমের মধ্যদিয়ে স্থানীয়ভাবে দলীয় কার্যক্রম সক্রিয় হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা বিএনপির সহসভাপতি নাজমুল হাসান তালুকদার রানা। ছাত্র রাজনীতিতে জেলা ছাত্রদলের নেতৃত্বসহ টানা তিনবার জেলা সদরের পৌর বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

দলের সব আন্দোলন ও সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকাসহ বারবার কারা নির্যাতিত এই নেতার জেলা বিএনপিতে রয়েছে বাড়তি ইমেজ। জেলা বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার পাশাপাশি তার গ্রামের বাড়ি কাজিপুর হওয়ায় এ অঞ্চলের রাজনীতিতে তার সম্পৃক্ততা ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের পর এ আসনের বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা আগের চেয়ে আরো নাজুক হয়ে পড়ে।

দীর্ঘ সময় এ আসনে বিএনপির রাজনৈতিক চর্চা বন্ধ থাকলেও নবগঠিত জেলা বিএনপির কমিটি ঘোষণার পর এখন দলের প্রবীণ ও নবীনরা সংগঠিত হচ্ছে। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, দলীয় কার্যালয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রমে বাধার কারণে চায়ের দোকান, বাজার ও সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে আগামী নির্বাচনে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

নাজমুল ইসলাম রানা তালুকদার জানান, বিগত সময়ে একবার এই আসনের জন্য মনোনয়ন চাইলেও সেবার দল তাকে মনোনয়ন দেয়নি। কিন্তু এবার তিনি দলের আস্থা তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, দল তাকে মনোনয়ন দিলে এবার ভোটাররা তার প্রতি আকৃষ্ট হবেন এবং সে লক্ষ্যেই তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।

অপরদিকে, এই আসনে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য এবং আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী থাকার কারণে বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর ধারণা আসনটির দখল পেতে প্রার্থী নির্বাচনে আনতে হবে বৈচিত্র্য; যা সাধারণ ভোটারদের মনোযোগ কাড়বে। এরই ধারাবাহিকতায় গুঞ্জন রয়েছে প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী কনক চাপাকে এই আসনে বিএনটির প্রার্থী হিসেবে দেখা যেতে পারে। কনক চাপার জন্মস্থান এই উপজেলায় হওয়ায় এ গুঞ্জন এখন ডালপালা মেলছে।

এছাড়া এক সময়ের উদ্যোমী ছাত্রনেতা ও বর্তমান জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি অধ্যাপক মো. রহমতুল্লাহ আয়ুব এই আসনে দল থেকে মনোনয়ন চাইবেন। তিনি জানান, তার জন্মস্থান কাজিপুর হওয়ায় এলাকায় তার পরিচিতি রয়েছে। পাশাপাশি বিগত সময়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণেও দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে রয়েছে তার বাড়তি গ্রহণযোগ্যতা; যা ভোটযুদ্ধে সহায়ক হবে।

এছাড়া জেলা বিএনপির সহসভাপতি মকবুল হোসেন চৌধুরীর নামও সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় রয়েছে। সদর উপজেলার যে ৪টি ইউনিয়ন কাজিপুর আসনে অর্ন্তভুক্ত তার বাড়ি ওই অঞ্চলেই। তার মতে, ভোটার আধিক্য এই ৪টি ইউনিয়নে তার রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। এছাড়া কাজীপুরেও তার জনপ্রিয়তা রয়েছে।

অপরদিকে, উপজেলা বিএনপির অনেক পুরনো কমিটির সভাপতি হিসেবে রয়েছেন সেলিম রেজা। দীর্ঘদিন সাংগঠনিক কাজে তিনি সক্রিয় না থাকলেও, আগামী সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় তিনিও রয়েছেন। বিগত সময়ে নেতাকর্মীদের দুঃসময়ে পুরোটা সময় ঢাকায় অবস্থান ও দলীয় কাজে অংশগ্রহণ না করায় তাকে নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।

জাতীয় পার্টি: মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি থেকে আব্দুল মোমিন মনোনয়ন চাইবেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিলেও পরে তিনি প্রত্যাহার করে নেন।

জাসদ: মহাজোটের শরিক জাসদের সিরাজগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই তালুকদারের বাড়ি এ আসনের বাগবাটি ইউনিয়নে। আগামী নির্বাচনে মহাজোটের হয়ে এ আসনে জাসদ তাদের প্রার্থী চাইবেন বলে শোনা যাচ্ছে। এ কারণে জাসদ নেতা আব্দুল হাই তালুকদার মনোনয়ন প্রত্যাশী। ইতিমধ্যে সামাজিক অনুষ্ঠান ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়ও করছেন তিনি। এমজমিন

এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে