সিলেট: সিলেটের দক্ষিণ সুরমার কাজী পরিবারের ‘দুই কইন্যা’ এখন বড় অসহায়। একই গোষ্ঠীর স্বজনদের ক্রমাগত হুমকির কারণে মৃত্যু তাড়া করে ফিরছে তাদের। ইতিমধ্যে তাদের উপর হয়েছে হামলা। গোষ্ঠীর পাঁচের বাদ করে রাখায় এখন পাড়ার মক্তরে তাদের যাওয়া-আসাও বন্ধ। রাস্তায় বের হলেই তারা থাকেন হামলার তটস্থে। সিলেটের দক্ষিণ সুরমার কাজী পরিবারের ওই দুই বোনের নাম কাজী সুলতানা ও কাজী ইয়াসমীন।
গতকাল সিলেটে সংবাদ সম্মেলনে দুই বোন তাদের দুঃখের কথা জানিয়েছেন। সহায়তা চান প্রশাসনসহ সাংবাদিকদের। বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী একটি রাজনৈতিক দলের ছায়ায় থাকা ওই চক্রের সদস্যরা তাদের ফলো করছে। যে কোনো সময় তারা হামলায় মারাও যেতে পারেন। ঘটনার সূত্রপাত প্রায় ৮ বছর আগে। ২০০৮ সালে।
কাজী সালমার ছোটো বোন কাজী ইয়াসমীনের বিয়েকে কেন্দ্র করে। কাজী ইয়াসমীন ভালোবাসতেন পাশের গ্রাম গোপশহরের বাসিন্দা কবির উদ্দিনকে। কবির উদ্দিন সিলেটের রেলওয়ে এলাকার কাঠ ব্যবসায়ী। তারা দুইজন একে-অপরকে ভালোবেসে গোপনে বিয়ে করেন। ২০০৮ সালের ১১ই আগস্ট বিয়ের পর প্রথমে কাজী ইয়াসমীন কিছুদিন পিতার বাড়ি থাকলেও পরবর্তীতে স্বামীর বাড়ি চলে যান।
স্বামীর পরিবারও তাকে সাদরে গ্রহণ করেন। কিন্তু বাদ সাধেন কাজী ইয়াসমীনের গোষ্ঠী সম্পর্কে চাচা কাজী আফসর, কাজী ময়নুল ও কাজী ফয়েজ। তারা ভালোবাসার গোপন বিয়ে মেনে নেননি। এতে করে কাজী পরিবারের সম্মানহানি হয়েছে দাবি করে তারা ক্ষুব্ধ হন ইয়াসমীনের উপর।
বিয়ের মাসেই একদিন জোরপূর্বক কাজী আফসরসহ কয়েকজন জোরপূর্বক কবির ও ইয়াসমীনকে তুলে নিয়ে আসেন তার বাড়িতে। নিয়ে যান কাজী। তালাক সম্পাদন করতে তারা জোর খাটান। কিন্তু ওই তালাকে সই দিতে রাজি হননি ইয়াসমীন কবির দুই জনই। তাদের উপর শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে জোরপূর্বক তালাকে বাধ্য করা হয়।
কিন্তু তালাকে তারা দস্তগত নিলে সেটি আদালতের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য হয়নি। ফলে কিছুদিন পর কাজী ইয়াসমীন ফের স্বামী কবির উদ্দিনের বাড়ি চলে যান। এখন কবির ও ইয়াসমীনের সংসারে দু’টি সন্তান। এক সন্তানের বয়স ৫ বছর ও অপরটির ১৫ মাস। এদিকে, ইয়াসমীন দ্বিতীয় দফা স্বামীর বাড়ি চলে যাওয়ার পর কাজী আফসরসহ কয়েকজন তাকে নিজ বাড়িতে আসতে বারণ করে দেন।
এমনকি ইয়াসমীনের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখতে তার ভাই ও মাকে নিষেধ দেয়া হয়। এ কারণে ইয়াসমীন দীর্ঘ ৮ বছর আসেননি পিতার বাড়িতে। এমনকি একমাত্র ভাইয়ের বিয়েতেও আসতে পারেননি। সম্প্রতি সময়ে মা অসুস্থ থাকায় কাজী ইয়াসমীন পিতার বাড়িতে আসা যাওয়া শুরু করেন।
এদিকে, সন্তানের পড়ালেখার কারণে কাজী ইয়াসমীনের বড় বোন কাজী সুলতানা বিয়ানীবাজারে স্বামীর বাড়িতে না থেকে পিতার বাড়িতে বসবাস করছেন। বড় বোনকে দেখতে ইয়াসমীন পিতার বাড়িতে আসতে শুরু করেন। কিন্তু বাদ সাধেন গোষ্ঠীর চাচারা। তারা ক্ষেপে যান।
এ নিয়ে তারা কাজী ইয়াসমীনের পরিবারের উপর চাপ প্রয়োগ শুরু করেন। এমনকি তারা তাদের পঞ্চায়েতে তাদের বাদ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন। কিন্তু এলাকার মানুষ কাজী আফসরদের সে নির্দেশে সায় না দেয়ায় অবশেষে কাজী ইয়াসমীনের পরিবারকে পঞ্চায়েতে বাদ করে রাখা হয়।
এদিকে, গতকাল সিলেট জেলা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে কাজী সুলতানা সম্প্রতি সময়ে হামলা, মামলার ঘটনার তুলে ধরে বক্তব্য দিয়েছেন। জানিয়েছেন, গত ২৩শে সেপ্টেম্বর তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের বন্দি করে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্ম দেন কাজী আফছর, কাজী ময়নুল ও কাজী ফয়েজ ও তাদের লোকজন।
বিয়ের শত্রুতা ধরে পরিবারের সদস্যদের অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করলে তিনি বাধা দেন। একপর্যায়ে তারা দা, লাঠি, হকিস্টিক নিয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করে। তাদের হামলায় সুলতানা, তার বোন কাজী ইয়াসমীন ও মা আনোয়ারা বেগম গুরুতর আহত হন।
খবর পেয়ে দক্ষিণ সুরমা থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিবারকে উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করে। কিন্তু অভিযুক্ত কাউকে তাৎক্ষণিক আটক করেনি।
এ ঘটনায় সুলতানা এজাহার দাখিল করলে প্রথমে মামলা নেয়নি দক্ষিণ সুরমা থানা পুলিশ। বিষয়টি পুলিশ কমিশনারকে অবহিত করার পর ২৮শে সেপ্টেম্বর মামলা রুজু করে পুলিশ। মামলায় একই বাড়ির আত্মীয় কাজী ময়নুল, কাজী ফয়েজ, কাজী আফছর, কাজী আবিদ, কাজী মুহিত, কাজী রোমান, কাজী আবুল ও লুৎফা বেগমকে আসামি করা হয়েছে। কিন্তু আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় পুলিশ এখন পর্যন্ত তাদের গ্রেপ্তার করছে না।
সুলতানা জানান, এর আগেও তাদের অতীত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে থানায় জিডি ও পুলিশ কমিশনার বরাবর অভিযোগ করা হয়েছে। বোন কাজী ইয়াসমিন ২০১৫ সালের ১৫ই নভেম্বরে জীবনের নিরাপত্তা ও পাওনা টাকা উদ্ধারে পুলিশ কমিশনার বরাবরে অভিযোগ দেন। পরে বিষয়টি এলাকার লোকজন মিলে নিষ্পত্তি করেন।
কিন্তু দীর্ঘদিন পর আবার তারা উৎপাত শুরু করে। বর্তমানে তাকেসহ ছোট বোনের স্বামী কবির উদ্দিন, বড় ভাই কাজী ডালিমকে মামলায় জড়ানোর চেষ্টা করছে। যে কোনো সময় আসামিরা আবার হামলা-মামলা দিয়ে হয়রানি করতে পারে।
কাজী ইয়াসমীন জানিয়েছেন, ‘আমি বিয়ে করেছি নিজের ইচ্ছায়। আমাদের দু’টি পরিবারে সম্পর্কের কোনো অবনতি ঘটেনি। বরং আমরা সুখে আছি। কিন্তু আমার গোষ্ঠীর চাচারা পিছু ছাড়ছে না।’ তিনি বলেন, ‘ওরা জামায়াত-শিবির করে। ক্রমাগত হুমকির কারণে তটস্থ অবস্থায় আছি। কিন্তু তাদের উপর মামলা সত্ত্বেও পুলিশ গ্রেপ্তার করছে না।’-এমজমিন
০৬ অক্টোবর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ