ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে : ‘আমি অপহৃত হইনি। রনিকে ভালোবাসি। তাই বিয়ে করেছি। রনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমরা দীর্ঘদিনের প্রেমের পরিণতি হিসেবে একই ছাদের নিচে আশ্রয় নিয়েছি।’- পিতা সনাতন হামোমের অপহরণের মামলায় প্রেমিক রনি সিংহকে নিয়ে ১০ দিন পলাতক থাকার পর গতকাল সিলেটের আদালতে হাজির হয়ে এ কথা জানান আলোচিত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ঐশী হামোম।
আর তার দেয়া ২২ ধারার জবানবন্দি পর্যালোচনার পর সিলেটের আদালত প্রেমিক স্বামী রনি সিংহকেও জামিন দিয়েছে। আদালত থেকে জামিন পাওয়ার পর বিয়ের ১০ দিনের মাথায় একসঙ্গে মুক্ত হাওয়ায় বিচরণ শুরু করল সিলেটের আলোচিত এই প্রেমিকজুটি। তাদের নিয়ে দীর্ঘ ১০ দিন আলোচনার অন্ত ছিল না সিলেটে। ঐশীর পিতা সনাতন হামোম অপহরণের বিষয়টি জোরালোভাবে উপস্থাপন করায় র্যাব ও পুলিশ ঐশীর খোঁজে হন্য হয়ে অভিযান শুরু করেছিল।
এ কারণে অভিযানের মুখে বারবার স্থান পরিবর্তন করে পালিয়ে থাকতো হয়েছিল এই নবদম্পতিকে। অবশেষে গতকাল আদালতের মাধ্যমেই আলোচিত এ ঘটনার ইতি ঘটলো। ঐশী হামোম আদালতে জানান, ‘আমি অপহৃত হইনি। মনের মানুষ রনির সঙ্গে সংসার পেতেছি।’ স্বেচ্ছায় রনিকে কোর্ট ম্যারেজ করেছেন বলে আদালতে জানান তিনি। তার বক্তব্যটি লিখিত আকারে গ্রহণ করেন আদালত। সিলেটের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের এবারের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী ঐশী হামোম।
তিনি মনিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়ের। তার বাড়ি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদিবাসী এলাকায়। পিতা সনাতন হামোম। ঐশী সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত মুখ। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তার জুড়ি নেই। এ কারণে ছাত্র-শিক্ষকের প্রিয় ছিলেন তিনি। বসবাস করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হোটেলে। গত ৭ই নভেম্বর ঐশী হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যায়। তবে, বান্ধবীর মোবাইল ফোনে মেসেজে জানিয়েছিল- তিনি হলে ফিরবেন না, মাসির বাড়ি যাচ্ছেন। প্রথমে নিখোঁজ ধারণা করা হলেও পুলিশ প্রযুক্তিগত অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারে ঐশী তার প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়েছেন।
পরে পরিবারের পক্ষ থেকে সিলেটের শাহপরান থানায় অপহরণ মামলা করা হয়। ওই মামলায় ঐশীর প্রেমিক উৎপল সিংহ রনি ছাড়াও তার বাবা উপেন্দ্র সিংহ ও পরিবারের সদস্যদের আসামি করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ রনি সিংহের স্বজন ব্রজেন সিংহকেও অপহরণ মামলায় গ্রেপ্তার করে। তবে, ব্রজেনের কাছে ঐশী ও রনি প্রেম সম্পর্কের পুরো ধারণা পায় পুলিশ। রনি সিংহের পুরো নাম উৎপল সিংহ রনি। তিনি সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির ছাত্র। তার বাড়ি হবিগঞ্জে। সিলেট শহরেই একগোত্রী ঐশীর সঙ্গে পরিচয় হয় রনি সিংহের। এরপর থেকে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রনির টানে প্রায় সময় ক্যাম্পাস থেকে শহরে ছুটে আসতেন ঐশী।
তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হতো। হতো অভিসারও। এসব ঘটনা যখন ধীরে ধীরে এগুতে থাকে তখন আসে বিয়ের কথা-বার্তাও। দুই পরিবারের মধ্যে বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা হলেও সম্মতি হয়নি। ফলে রনি ও ঐশীর দুই বছরের প্রেমের সম্পর্কের পরিণতি নিয়ে দুজনের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। শুধু প্রেমের সম্পর্কের মধ্যে তারা বন্দি থাকেননি। ৭ই নভেম্বর ঐশী হামোম প্রাইভেট পড়তে সিলেট নগরীর সুবিদবাজার এলাকায় আসেন। আর ওখান থেকে প্রেমিক রনি সিংহের সঙ্গে তিনি অজানায় ঘর ছাড়েন।
পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, পালিয়ে যাওয়ার পরপরই দুজন আদালতের মাধ্যমেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। প্রথমে তারা শ্রীমঙ্গল এলাকায় অবস্থান করলেও পুলিশ ও র্যাবের অভিযানের মুখে তারা হবিগঞ্জের বানিয়াচং এলাকায় অবস্থান নেন। এরপরও পুলিশ ও র্যাবের কারণে তারা ছিলেন তটস্থ। এছাড়া অপহরণ মামলার আসামি হওয়ার কারণে রনি সিংহের পরিবারের লোকজনও পড়ে বেকায়দায়। তারাও পালিয়ে পালিয়ে পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পায় ১০ দিন।
এই অবস্থায় গতকাল দুপুরে সিলেটের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম সরাবন তহুরার আদালতে হাজির হন ঐশী হামোম ও রনি সিংহ। এ সময় ঐশীকে কিছুটা অসুস্থ দেখাচ্ছিল। রনির পরিবারের সদস্যরাও জানিয়েছে, অতিরিক্ত জার্নির কারনে ঐশী কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বেলা দুটার থেকে তিনি আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দি দেন। আর ওই জবানবন্দিতে তিনি নিজেকে প্রাপ্ত বয়স্কা দাবি করেন।
তিনি বলেন, ‘আমি অপহৃত হয়নি। ভালোবেসে রনিকে বিয়ে করেছি।’ আদালত তার জবানবন্দি গ্রহণের আগেই ঐশীর পিতা সনাতন হামোম মেয়েকে তার জিম্মায় দেয়ার আবেদন জানান। কিন্তু আদালত ঐশীর কাছে জানতে চান- তিনি কার জিম্মায় যাবেন। এ সময় ঐশী জানান- সে যেহেতু প্রাপ্তবয়স্কা এ কারণে নিজ জিম্মায় যাবেন। রনিকে তার স্বামী হিসেবেও আদালতে উল্লেখ করেন। আদালত ঐশী হামোমের বক্তব্য পর্যালোচনার পর ঐশীকে নিজ জিম্মায় জামিন দেন। একই সঙ্গে অপহরণের ঘটনায় অভিযুক্ত রনি সিংহকেও জামিন দেন। জামিন প্রদানের পর যখন ঐশী হামোম বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন বারান্দায় অঝোরে কাঁদছিলেন ঐশীর মা।
আইনজীবীরা জানিয়েছেন, ঐশী ও রনি দুজন প্রাপ্ত বয়স। ২৩-২৪ বছর বয়স তাদের। সুতরাং তারা একে অপরকে বিয়ে করতেই পারেন। আদালতের বিশ্বাস হয়েছে, ঐশী অপহৃত হয়নি। এ কারণে দুজনকেই জামিন দিয়েছেন। তবে, ঐশীর আইনজীবীরা বিষয়টিকে অপহরণ বলে আদালতকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তারা ঐশীকে পিতার জিম্মায় ও রনিকে মামলা শেষ না পর্যন্ত কারাগারে রাখার আর্জি জানান।
এদিকে, আদালত থেকে জামিন পাওয়ার পর ফের এক ছাদের নিচে রনি সিংহ ও ঐশী হামোম। আর এরই মধ্য দিয়ে সিলেটের আলোচিত এ প্রেমিকজুটির দ্বৈত জীবন পর্ব শুরু হলো। এমজমিন
১৮ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি