ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে : ‘উৎপল সিংহ রনি আমাকে জোরপূর্বক অপহরণ করেছে। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাগজে দস্তগত নিয়েছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে (প্রকাশ অযোগ্য শব্দ) করেছে।’-এসব কথা উল্লেখ করে রনি সিংহকে ডিভোর্স দিয়েছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ঐশী হামোম। টানা ৪ দিন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ শেষে বাড়ি ফেরার পথে গত রোববার সিলেটের আদালতে এফিডেভিটের মাধ্যমে ঐশী ডিভোর্স দেন।
গতকাল কাছে ঐশী জানিয়েছেন, ‘আমি যখন ওদের হাতে বন্দি তখন আমার শারীরিক অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছিল। টানা নির্যাতনে আমি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। আর ওই সময় তারা বলেছিল- আদালতে রনির পক্ষে বক্তব্য না দিলে তারা আমার বাবা-মা ও ভাইকে হত্যা করে ফেলবে। এ কারণে বাধ্য হয়ে আমি আদালতে তাদের শেখানো বুলি বলেছি।’ এখন ঐশী তাকে অপহরণ ও নির্যাতনের বিচার চান। এই দাবিতে রনির পরিবারের বিরুদ্ধে আদালতে লড়াই চালিয়ে যাবে ঐশীর পরিবার।
ঐশী গতকাল এই প্রতিবেদকের কাছে রনির সঙ্গে প্রেম, প্রত্যাখ্যান, অপহরণ, নির্যাতন- এসব নিয়ে কথা বলেছেন। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের শেষ বর্ষের ছাত্রী ঐশী হামোম। মণিপুরী সম্প্রদায়ের ওই মেয়েটি বসবাস করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হোস্টেলে। তার পিতা সনাত হামোম। বাড়ি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার কোনাগাঁও গ্রামে। ঐশী হামোম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হওয়ায় একই গোত্রীয় উৎপল সিংহ রনির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। রনি সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী।
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার শিবনগর গ্রামের উপেন্দ্র সিংহের ছেলে সে। তার মা নন্দরানী সিনহা একই এলাকার হাজী বেগম খান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। ঐশীর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর প্রায়ই দেখা হতো তাদের। এ কারণে প্রায় ৩ বছর আগে রনির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে ঐশীর। কিন্তু প্রেমের পর ঐশী জানতে পারেন রনি বখাটে। সে ইয়াবা সহ বিভিন্ন মাদক গ্রহণ করে। বিষয়টি নিয়ে ঐশী তার বন্ধু মহলে আলোচনা করে।
এমনকি প্রেমের সম্পর্ক থাকাকালে প্রায় সময় রনি ঐশীকে মারধর করে। এ কারণে গত দেড় বছর ধরে ঐশী প্রেমিক রনির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে। সে রনিকে ভালো পথে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে যোগাযোগ ছেড়ে দেয়। আর ওই সময় রনির পিতা উপেন্দ্র ও মা নন্দরানী বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন ঐশীর বাবা সনাতন হামোমের কাছে। কিন্তু রনির চরিত্রগত সমস্যা থাকায় বিয়ের বিষয়ে সাড়া দেয়নি পরিবারটি।
এদিকে, ঐশীর কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে রনি আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। সামনের বিসিএস পরীক্ষায় ঐশী অংশ নেবেন। এ কারণে ঐশী নগরীর সুবিদবাজারে কোচিং করতে আসেন। কিন্তু কোচিংয়ে আসার সময় রনি তাকে প্রায়ই উত্ত্যক্ত করতো। এতে করে বিষিয়ে উঠেছিল ঐশীর জীবন। গত ছুটির মৌসুমে ঐশী বাড়িতে থাকাকালে পরিবারের লোকজনকে বিষয়টি জানিয়েছেন। পরিবার থেকে তাকে অভয় দেয়া হয়েছে। এ কারণে ঐশী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসে।
ঐশী জানায়, ৭ই নভেম্বর সে সন্ধ্যায় রিকশা নিয়ে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে ফিরছিল। বালুচরের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গলির মুখে আসামাত্র একটি মাইক্রোবাস নিয়ে রনি তার পথ আটকায়। নির্জন ওই স্থান থেকে অনেকটা জোরপূর্বক তাকে নিয়ে মাইক্রোবাসে করে চলে যায়। এদিকে, মাইক্রোবাসে ওঠানোর পর ঐশীকে প্রচণ্ড মারধর করে রনি। চোখ-মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়। ওই দিনই ঐশীকে নিয়ে শ্রীমঙ্গলে চলে যায় রনি। সেখানে এক আত্মীয়ের বাসায় তাকে রাখে। এবং ঐশীর মোবাইল ফোন থেকে রনি বান্ধবীর কাছে মেসেজ পাঠায়। আর ওই মেসেজে লিখা ছিল-‘আজ হলে ফিরবো না- মাসির বাড়ি যাচ্ছি।’
এদিকে, এশীকে নিয়ে যে ১০ দিন রনি ছিলেন ওই সময় তারা ৭টি স্থান বদল করেছে বলে জানায় ঐশী। বলেন, শ্রীমঙ্গল থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের একটি বাগানে। সেখানে রনির মা সহ আত্মীয়স্বজনরা আসেন। ওই বাগানে রাখার সময় রনি তার ওপর নির্যাতন চালায়। মাঝে মধ্যে মুখের বাঁধন খুলে দিলেও অধিকাংশ সময় মুখ বাঁধা থাকতো। অপহরণের তিন দিন পর রনি ও তার পরিবারের লোকজন ঐশীকে নিয়ে যান হবিগঞ্জের এক আইনজীবীর বাসায়। সেখানে নেয়ার আগে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। আইনজীবীর বাসায় নেয়ার পর তাকে কাগজে দস্তগত দিতে বলা হয়। কিন্তু ঐশী দস্তগত দিতে রাজি না হওয়ায় তাকে মারধর করা হয়। এতে বাধ্য হয়ে ঐশী ওই কাগজে দস্তগত করেন বলে জানান।
তিনি বলেন, ‘রনির নির্যাতনের কারণে প্রায় সময় অচেতন থাকতাম। শেষদিকে শরীর প্রায় অবশ হয়ে গিয়েছিল। চলাফেরার শক্তিও হারাতে বসেছিলাম। অচেতন অবস্থায় আমার ওপর অনেক নির্যাতন হয়েছে।’ এসব নির্যাতনের কারণে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে জানান। ওদিকে, ঐশী অপহরণের ঘটনায় সিলেটের শাহপরান থানায় মামলা দায়ের করার পর পুলিশ তৎপর হয়ে উঠে। এ কারণে ঐশীকে নিয়ে পালিয়ে থাকা দুষ্কর হয়ে পড়ে রনির। গত ১৬ তারিখ রনি সিংহ ও তার পরিবারের লোকজন ঐশীকে জানায়- আদালতে হাজির হবে। এবং আদালতে রনির পক্ষে কথা বলার জন্য চাপ প্রয়োগ করে।
ঐশী জানিয়েছেন, ‘আদালতে নিয়ে আসার আগে তারা জানিয়ে দেয়- যদি রনির পক্ষে বক্তব্য না দেই তাহলে তারা আমার বাবা-মা ও ভাইকে খুন করে ফেলবে। এসব হুমকিতে আমি তটস্থ হয়ে পড়ি। আর ১৭ই নভেম্বর সিলেটের আদালতে হাজির করার পর আমি রনির পক্ষে বক্তব্য দেই।’ ওই দিন আদালত ঐশীর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে রনি সিংহকে জামিন দিয়েছেন। আর ঐশীকে নিজ জিম্মায় জামিন দেন। নিজের জিম্মায় জামিন পাওয়ার পর ঐশী সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই সময় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পিতা সনাতন হামোম, মা ঊষা রানী সিনহা ও ভাই সাগর হামোম। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর মা-বাবাকে কাছে পেয়ে ঐশী অঝোরে কাঁদেন।
ঐশী জানান, তার ওপর নির্যাতনের কথা। আদালতের নির্দেশে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে ঐশীর মেডিকেল চেকআপ করানো হয়েছে। এরপর আরো দুই দিন চিকিৎসা দেয়ার পর ২০শে নভেম্বর সে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান। এবং মা- বাবার সঙ্গে নিজ বাড়ি কমলগঞ্জে চলে যান। যাওয়ার আগে সিলেটের আদালতে গিয়ে ঐশী এফিডেভিটের মাধ্যমে উৎপল সিংহ রনিকে ডিভোর্স দিয়েছেন। ঐশী ডিভোর্সের কপিতে জানান, রনি সিংহ তাকে জোরপূর্বক অপহরণ এবং পরে (প্রকাশ অযোগ্য শব্দ) করেছে। নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে কাগজে তার মতের বিরুদ্ধে দস্তগত নিয়েছে। ঐশী এখন গ্রামের বাড়িতেই আছেন।
গতকাল জানান, ‘আমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে। একটি ঝড় আমাকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। আমি আবার ঘুরে দাঁড়াতে চাই। আবারো বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবো। বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবো। আবার স্বাভাবিক হবো।’ আদালত সূত্র জানিয়েছে, ঐশীর পিতার দায়ের করা মামলায় আসামি ছিলেন রনি, তার পিতা উপেন্দ্র সিংহ, মা নন্দারানী সিনহা সহ আরো কয়েকজন। তারা ইতিমধ্যে আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন।
ঐশীর পিতা সনাতন হামোম জানিয়েছেন, আদালতে হাজির করার দিন ঐশী গুরুতর অসুস্থ ছিল। তার ওপর যে মানসিক নির্যাতন চালানো হয় এতে করে সে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ছিল। এ কারণে টানা ৪ দিন তাকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেয়ার পর সে কিছুটা সুস্থ হয়েছে। তিনি বলেন, তিনি আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন। তার মেয়েকে জোরপূর্বক অপহরণ করে নির্যাতন চালানো হয়েছে। এ ঘটনার বিচার তিনি চাইবেন আদালতের কাছে। এমজমিন
২৩ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি