শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট থেকে : সিলেটে দানশীল ও বিত্তশালী শব্দের উপমা হয়ে উঠেছিল রাগীব আলী নামটি। নিজস্ব অনুসারী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে শেষ নেই তার বিশেষণের। কারও কাছে তিনি দানবীর, কারও কাছে শিল্পপতি।
জামায়াত-শিবিরকে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ থাকলেও রাগীব আলী নিজেকে পরিচয় দিতেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে। রাগীব আলীকে ‘উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ দানবীর’ দাবি করে শুভাকাঙ্ক্ষীরা দীর্ঘদিন ধরে তাকে রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত করারও দাবি জানিয়ে এসেছেন। রাগীব আলী মামলার জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে সেসব ঘনিষ্ঠজন, শুভাকাঙ্ক্ষী গা বাঁচাতে পিছটান দিয়েছেন।
রাগীব আলীর চরম দুর্দিনে কেউ নেই তার পাশে। যাদের বছরের পর বছর নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, কেউই নেই তার পাশে। যারা রাষ্ট্রীয় পদক দেওয়ার জন্য রাগীব আলীর হয়ে গলা ফাটিয়েছেন, তারা রাগীব আলীর বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদ কিংবা তার কারাবরণের বিরুদ্ধে ‘টুঁ’শব্দটিও করেননি। সব থাকা সত্ত্বেও যেন রাগীব আলী এখন ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার!
জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে সিলেটের তারাপুর চা বাগান দখলসংক্রান্ত দুটি মামলায় রাগীব আলী, তার ছেলে আবদুল হাই, নিকটাত্মীয় মোস্তাক মজিদ কারাগারে রয়েছেন। রাগীব আলীর মেয়ে রুজিনা কাদির ও জামাতা আবদুল কাদির পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কারাগারে যাওয়া থেকে বাঁচতে রাগীব আলী ছেলেকে নিয়ে ভারতে পালিয়েছিলেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি।
বৃহস্পতিবার ভারতে গ্রেফতার হওয়ার পর দেশে তাকে এনে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি তারাপুর চা বাগানের দখল ছাড়তে এবং এ বাগান দখলসংক্রান্ত দুটি মামলা সক্রিয় করতে নির্দেশ দেয় আপিল বিভাগ। এর পর থেকেই ধীরে ধীরে কোণঠাসা হতে থাকেন রাগীব আলী। সুসময়ে আশপাশে ঘুরঘুর করা কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদসহ সবাই সরে যেতে থাকেন তার পাশ থেকে। ক্রমেই একা, অসহায় হয়ে পড়েন রাগীব আলী। রাগীব আলী হঠাৎই তার নামের আগে ‘ডক্টর’ ও ‘সৈয়দ’ উপাধি ব্যবহার শুরু করেন।
এ নিয়ে জনমনে হাস্যরসের সৃষ্টি হলেও চাটুকাররা তাকে এসব উপাধি ব্যবহারে উৎসাহী করে তোলেন। ‘টাকার কুমির’ রাগীব আলীর টাকা দিয়েই তাকে ‘গণসংবর্ধনা’ প্রদান করা হয়। সিলেট সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচনের আগে নগরীর আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে ওই সংবর্ধনায় সিলেট আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা উপস্থিত ছিলেন। সিলেটের সুশীলসমাজের অনেক ব্যক্তি, ‘বিশিষ্ট’ কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বেশির ভাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওই সংবর্ধনা সভায় উপস্থিত ছিলেন।
গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠান থেকে রাগীব আলীকে রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত করারও দাবি উঠেছিল। সেই উৎসাহীদের কেউই এখন রাগীব আলীর পাশে নেই। রাগীব আলী তার নিজের নামে, স্ত্রী রাবেয়া খাতুনের নামে ‘রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার’ এবং ‘রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশন একুশে পুরস্কার’সহ বিভিন্ন পুরস্কার প্রদান করতেন। মোটা অঙ্কের এসব পুরস্কার পেতে রাগীব আলী বন্দনায় মেতেছেন অনেক কবি, সাহিত্যিক, বিশিষ্টজন। পুরস্কার পেয়ে গদগদ হয়ে নতুন উৎসাহে ‘রাগীব বন্দনা’য় মেতেছেন তাদের অনেকেই।
রাগীব আলীকে নিয়ে লেখা কয়েকটি বই হচ্ছে ‘মূল্যায়নের মানদণ্ডে রাগীব আলী’, ‘মাটি ও মানুষের রাগীব আলী’, ‘রাগীব আলী—কর্মই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে’, ‘দানবীর রাগীব আলী নিবেদিতপ্রাণের কথা গানে’, ‘রাগীব আলী—এ লিজেন্ড অব সাকসেস’, ‘দানবীর রাগীব আলীর মহান কর্মযজ্ঞের রূপরেখা’ প্রভৃতি। সেসব বইয়ের লেখক ও ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’র কাউকেই এ দুঃসময়ে রাগীব আলীর পাশে দেখা যাচ্ছে না। রাগীব আলীর টাকায় সিলেটের অনেকেই হজ পালন করেছেন, অনেকেই বাড়িঘর বানিয়েছেন, নিজ নিজ এলাকায় অনেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
রাগীব আলীকে খুশি করতে অসংখ্য পুরস্কারেও তাকে ভূষিত করা হয়েছে। পুরস্কার পেয়ে রাগীব আলীও গুণগ্রাহীদের ‘খুশি’ করতে ভোলেননি। তবে চলমান দুঃসময়ে কারোরই দেখা পাচ্ছেন না তিনি। চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি রাগীব আলীর মালিকানাধীন স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় তাকে নিয়ে একটি সংবাদে নামের আগে উল্লেখ করা হয় ‘সমাজসেবামূলক অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, বরেণ্য শিল্পপতি, প্রবাসে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, শিল্প-সাহিত্য ও সাংবাদিকতার পৃষ্ঠপোষক, মানবকল্যাণে নিবেদিত প্রতিষ্ঠান রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, দানবীর রাগীব আলী...’।
রাগীব আলীর নামের আগে তার মালিকানাধীন পত্রিকা কিংবা ঘনিষ্ঠজন, শুভাকাঙ্ক্ষী, শুভানুধ্যায়ীদের ব্যবহূত অন্তত ৩০টি ‘বিশেষণে’র মধ্যে এ হচ্ছে কয়েকটি মাত্র! রাগীব আলীকে খুশি করতে তাকে নিয়ে যে কোনো সংবাদে এসব বিশেষণ ব্যবহার করে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রেরণ করা হয়েছে। কিন্তু রাগীব আলী মামলার আসামি হয়ে ফেরারি হওয়া এবং অবশেষে কারাগারে যাওয়ার পর এসব বিশেষণ আর ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। বিডি প্রতিদিন
২৬ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি