চৌধুরী মুমতাজ আহমদ : কৃষ্ণভক্তদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ইসকনের সিলেটের ভক্তরা দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। ইসকন সিলেটের অধ্যক্ষকে কেন্দ্র করে বিরোধের জের ভাঙনের সুর হয়ে দেখা দিয়েছে সিলেটে ইসকনের আকাশে।
ইতিমধ্যে ইসকন সিলেটের অধ্যক্ষ নবদ্বীপ দ্বিজ গৌরাঙ্গ দাস ব্রহ্মচারীসহ ইসকনের বাংলাদেশ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন ইসকন ভক্তরা। ডাক এসেছে মতবিনিময় সভার। শুক্রবারের সে সভা থেকে বিভক্ত হয়ে যেতে পারেন সিলেটের ইসকন ভক্তরা। অনেকেরই আশঙ্কা এর জের ধরে ভাঙন দেখা দিতে পারে পুরো বাংলাদেশের ইসকন সমাজে।
ইসকন সিলেটের অধ্যক্ষ নবদ্বীপ দ্বিজ গৌরাঙ্গ দাস ব্রহ্মচারী’র বিরুদ্ধে উঠে আসা ‘নারী কেলেঙ্কারি’র অভিযোগের সূত্র ধরেই মূলত সিলেট ইসকনে এ ঝড়। সিলেট ইসকনেরই কিছু ভক্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ আনেন। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় ইসকনে। অভিযোগ তদন্তে ইসকন বাংলাদেশের শীর্ষ নেতারা কমিটিও গঠন করে দেন। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনকে পাশ কাটিয়ে ইসকন অধ্যক্ষকে দায় থেকে অব্যাহতি দেয়ায় ক্ষোভ বাড়তে থাকে ইসকন ভক্তদের একটি অংশের মাঝে।
তারা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের পাশাপাশি নানা উপায়ে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। ইসকন অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগের ফিরিস্তি তুলে ধরে প্রচারপত্রও বিলি করেন। উত্তেজনা কেবলই বাড়তে থাকে। চলতি নভেম্বরে তা মারাত্মক রূপ নেয়। ৫ই নভেম্বর কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয় ইসকন সদস্য পাণ্ডব গোবিন্দ দাস, বুদ্ধিগৌর দাস, পরমেশ্বর কৃষ্ণ দাস, জয়কৃষ্ণ নাম দাস, ব্রজকৃষ্ণ দাসকে। উত্তেজনা, কানাকানি কেবলই বাড়তে থাকায় ১৬ই নভেম্বর নিয়ম ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে মন্দিরে বসবাসরত ইসকনের ৪ সদস্য পাণ্ডব গোবিন্দ দাস, বিপিন বিহারী দাস, ব্রজকৃষ্ণ দাস, প্রেমনিধি গৌরহরি দাসকে মন্দির থেকে বহিষ্কার করা হয়।
বহিষ্কারের এ ঘটনা জানাজানি হলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে ইসকনে। এর জের ধরে পরে হামলার ঘটনাও ঘটে। এসব ঘটনায় থানায় পাল্টাপাল্টি জিডিও হয়েছে। কোতোয়ালি থানায় প্রথম জিডি করেন ইসকন সিলেটের অধ্যক্ষ নবদ্বীপ দ্বিজ গৌরাঙ্গ দাস (নং: ১০১৫)। একই থানায় পাল্টা জিডি (নং: ১০২০) করেন ইসকনের বহিষ্কৃত সদস্য গোবিন্দ দাসও। ২১শে নভেম্বর এক পত্রে বহিষ্কৃতদের ব্যাপারে ইসকন ভক্তদের সতর্কবাণী দেন ইসকন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক শ্রী চারুচন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী। গত ১৯শে নভেম্বর মানবজমিনে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়।
বহিষ্কার ও শোকজকে কেন্দ্র করে সিলেটে ইসকনের বিভক্তি চরম আকারে রূপ নেয়। শোকজ ও বহিষ্কারাদেশকে চ্যালেঞ্জ করে ১লা ডিসেম্বর সিলেটের সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে স্বত্ব মামলা (নং: ১৩৪৪) দায়ের করেন পাণ্ডব গোবিন্দ দাস ব্রহ্মচারী, বুদ্ধিগৌর দাস, পরমেশ্বর কৃষ্ণ দাস, জয়কৃষ্ণ নাম দাস, ব্রজকৃষ্ণ দাস, বিপিন বিহারী দাস ও প্রেমনিধি গৌরহরি দাস। মামলায় তারা ইসকন সিলেটের অধ্যক্ষ নবদ্বীপ দ্বিজ গৌরাঙ্গ দাস ব্রহ্মচারী ওরফে নিখিল ভৌমিকের পাশাপাশি ইসকন বাংলাদেশের সভাপতি শুদ্ধস্বত্ত গোবিন্দ দাস ও সাধারণ সম্পাদক চারুচন্দ্র দাস ব্রহ্মচারীকেও বিবাদি করেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, ইসকন সিলেটের অধ্যক্ষ নবদ্বীপ দ্বিজ গৌরাঙ্গ দাসের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইসকন সাধারণ সম্পাদকের মৌখিক নির্দেশে তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। তখন তাকে ইসকন বাংলাদেশের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তিরস্কারও করেন। মামলায় নারী কেলেঙ্কারির পাশাপাশি নবদ্বীপ দ্বিজ গৌরাঙ্গ দাস ব্রহ্মচারীকে ‘স্মাগলার’ হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয় ইসকনে যোগদানের আগে থেকেই তিনি চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালের ৩০শে জুন যশোরের সীমান্তবর্তী শার্শা থানায় চোরাচালানের অভিযোগে একটি মামলা হয়। ঐ মামলায় ৩ জন আসামি ছিলেন। এর মধ্যে একজন হচ্ছেন মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার রসিকলাল ভৌমিকের ছেলে নবদ্বীপ দ্বিজ গৌরাঙ্গ দাস ব্রহ্মচারী ওরফে নিখিল ভৌমিক যিনি সিলেট ইসকনের অধ্যক্ষ। মামলায় তার সঙ্গে আসামি হিসেবে ছিলেন চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার বাদল চন্দ্র দেবনাথের ছেলে হৃদয় ওরফে মিঠু, বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার কালিপদ দাসের ছেলে গৌরকিশোর দাস। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০০০ সালের ১০ই মে যশোরের জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রত্যেককে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন। রায়ে তাদের ২ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয় অনাদায়ে আরো ৩ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেন।
ইসকন অধ্যক্ষকে নিয়ে জটিল পরিস্থিতির জের ধরে শুক্রবার ইসকন সিলেটের বিভাগীয় কমিটির উদ্যোগে মতবিনিময় সভার ডাক দেয়া হয়েছে। শুক্রবারের সভার পর থেকেই হয়তো দৃশ্যত ভাগ হয়ে যেতে পারেন সিলেটের ইসকন ভক্তরা। কারো আশঙ্কা, হয়তো ভাঙন ধরতে পারে ইসকন বাংলাদেশেও।
প্রতিবাদ ও বক্তব্য: ইসকনের উত্তেজনা প্রসঙ্গে গত ১৯শে নভেম্বর একটি দৈনিকে ‘নারীহীন রাজ্যে নারী নিয়ে ঝড়’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ করেন ইসকন সিলেট থেকে। প্রতিবাদলিপিতে, প্রতিবেদনে প্রকাশিত অভিযোগসমূহকে মিথ্যা, বানোয়াট, উদ্দেশ্যমূলক দাবি করে বলা হয় ঐ প্রতিবেদনে বুদ্ধিগৌর দাসকে ইসকন সিলেটের সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হলেও তথ্যটি সঠিক নয়। তবে সেই দৈনিকটির হাতে থাকা ২৮শে আগস্টে অনুষ্ঠিত ইসকনের একটি সভার কার্যবিবরণীতে বুদ্ধিগৌর দাসকে বিভাগীয় সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রমাণ পাওয়া যায়। মানবজমিন
৮ ডিসেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসবি