তুহিনুল হক তুহিন, সিলেট : ‘বাড়িত যাইতে মন চায় না। শহীদ মিনারই আমার বাড়ি, আমার ঠিকানা!’ কাজের ফাঁকে এমনটাই বলছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আপ্তাব আলী। তার কাজ মানে শহীদ মিনার দেখভাল করা। প্রধান ফটক ঠিকঠাক বন্ধ আছে কিনা, কেউ কোনও ময়লা-আবর্জনা ফেলে গেলে সেগুলো অপসারণ, আবার কোনও দর্শনার্থী ভুল করে শহীদ বেদিতে জুতা নিয়ে উঠল কিনা এসব বিষয়ের দিকে তার নজরদারি। এক কথায় তিনি শহীদ মিনারের ‘কেয়ারটেকার’।
সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনেকটা স্বেচ্ছায় একটানা ২৭ বছর এ দায়িত্ব পালন করছেন মুক্তিযোদ্ধা আপ্তাব আলী। সিলেটের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সবাই জানেন তার ঠিকানা শহীদ মিনার। শহীদ মিনারে নিয়মিত যাতায়াতকারী ছোট-বড় সবার কাছে তিনি প্রিয় ‘আপ্তাব ভাই’। তিনি যেন ২৭ বছর ধরে আগলে রেখেছেন শহীদ মিনার। যে মন দিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, সেই মন দিয়ে ভালোবাসেন যুদ্ধ জয়ের স্মারক শহীদ মিনারকে।
সিলেটের গোলাপগঞ্জের ভাদেশ্বর গ্রামের মৃত তৈইছ আলীর ছেলে আপ্তাব আলী তরুণ বয়সের একজন মুক্তিযোদ্ধা। ২২ বছর বয়সে যুদ্ধে যান তিনি। তাকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেন ৪নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন সি আর দত্ত। একদিন মৌলভীবাজারের আলীনগর চাতলাপুরে সম্মুখ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া গুলিতে তিনি আহত হয়েছিলেন। এখনও বুলেটের চিহ্ন তার বাম পায়ে। যার কারণে খুঁড়িয়ে চলতে হয় আপ্তাব আলীকে। মুক্তিযুদ্ধের আগে রাজমিস্ত্রীর কাজ করতেন। পায়ে আঘাত পাওয়ায় দেশ স্বাধীনের পর আর সেই পেশায় যেতে সাহস পাননি তিনি। তাই শহীদ মিনারকে দেখভাল করার কাজে মনোযোগী হন।
মুক্তিযোদ্ধা আপ্তাব আলীর বয়স যখন ২২ বছর তখন দেশে যুদ্ধ শুরু হয়। সে দিনের কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আপ্তাব আলী বলেন, ‘বেকার থাকার দায় বাফে (বাবা) মারছিলা (মারধর করেন)। তখন রাগ করি সিলেট আইয়া প্রতিদিন ৩ টেখা (টাকা) চুক্তিতে রাজমিস্ত্রীর কামে লাগি। অউ সময় কারফিউ চলের সিলেট। তখন প্রতিদিন রাত ৪টায় সিলেট থাকি ঢাকায় উল্কা ট্রেন নামের একটা ট্রেন যাইতো। অউ সময় ক্বীন ব্রিজের সামনে পাকিস্তানি সৈন্যরা যাত্রীদের আটকাইয়া গুলি করি করি মারছে। যা নিজের চোউখে দেখছি। পরের দিন শেখ সাবের (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) ভাষণ রেডিওত হুনিয়া সিলেট থাকি সোজা মুক্তি বাহিনীতে যোগ দেই।’
আপ্তাব আলী জানান, তখনকার প্রেক্ষাপটে তরুণ বয়সীদের নিরাপদে চলাফেরা করা আতঙ্কের ছিল। পাকিস্তানি সেনারা তরুণদের দেখে দেখে গুলি করে হত্যা করত। তাই দেশের অনেক পরিবার তখন তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়টাই নিরাপদ মনে করতো।
তিনি বলেন,‘তখন ৪নং সেক্টর কমান্ডার সিআর দত্ত অস্ত্র চালানোর জন্য আমাকে ভারতের লোহার বনে পাঠান। সেখানে ২১ দিনে অস্ত্র চালানো শিখে আবার সিলেটে আসি। এরপরে ক্যাপ্টেন রব ও ক্যাপ্টেন ওয়াকিউজ্জামানের নেতৃত্বে সিলেট ও মৌলভীবাজারে কয়েকটা অপারেশন চালাই।’
যুদ্ধের কথা স্মরণ করে আপ্তাব আলী বলেন, ‘যুদ্ধের সময় ভোরে মৌলভীবাজারের শমসেরনগরের নিতিনপুর ও কালিদিঘীতে আমিসহ তিনজন মিলে পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি আসা-যাওয়ার পথে গর্ত করে মাইন বোমা রেখেছিলাম। এরপর পাকিস্তানিদের কয়েকটা গাড়ি উড়িয়ে দিয়েছি। শমসেরনগরের নমুজাত মাদ্রসায় আমাদের ক্যাম্প ছিল।’
মুক্তিযোদ্ধা আপ্তাব আলীর পরিবারে স্ত্রী, দুই ছেলে আর চার মেয়ে। এদের নিয়ে টানাপোড়েনে চলে তার সংসার। কিন্তু শহীদ মিনারকে ঘিরে তার অকৃত্রিম ভালোবাসা পরিবারও মেনে নিয়েছে। ২৭ বছর ধরে শহীদ মিনারই তার ঠিকানা।
সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পরিচালানায় থাকা সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবীব বলেন, ‘আপ্তাব আলী স্বেচ্ছায় শহীদ মিনার দেখভাল করছেন। তাই সিটি করপোরেশন থেকে মাস শেষে তাকে কিছু সম্মানী দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ -বাংলা ট্রিবিউন।
০৯ ডিসেম্বর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম