তুহিনুল হক তুহিন, সিলেট : ‘আপু (খাদিজা আক্তার নার্গিস) যে বেঁচে আছেন, এখনও আমার কাছে তা স্বপ্নের মতো লাগে। যেভাবে চাপাতি দিয়ে বদরুল কুপিয়েছে আপুকে, এভাবে মানুষ পশুকেও কোপায় না। বদরুলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। তাইলে অপরাধ করতে মানুষের ভয় লাগবে।’ কথাগুলো বলেন নার্গিসকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ২০ বছরের তরুণ ইমরান কবীর।
গত ৩ অক্টোবর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি) ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদরুল আলম সিলেট এমসি কলেজের পুকুর পাড়ে সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিসকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। প্রকাশ্যে অনেক মানুষের সামনে এই ঘটনা ঘটলেও কেউ এগিয়ে আসেননি। সেদিন নার্গিসের সাহায্যে এগিয়ে যান এই ইমরান কবীর। পুকুর পাড়ে রক্তাক্ত পড়ে থাকা নার্গিসকে একাই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। নার্গিস তখন জ্ঞানহীন। মাথা দিয়ে রক্ত পড়া দেখে ইমরান নার্গিসের মাথার ওড়না খুলে পুরো মাথা বেঁধে নেন। পরে তার চিৎকার শুনে আরও দুইজন এগিয়ে আসলে তারা ধরাধরি করে নার্গিসকে নিয়ে যান সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালে নিয়ে গিয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি ইমরান। নিজের শরীর থেকে এক ব্যাগ রক্তও দিয়েছিলেন খাদিজাকে।
ইমরান কবীর সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ঢালার পাড় গ্রামের স্কুল শিক্ষক নজরুল ইসলামের ছেলে। চার বছর ধরে সিলেট নগরের টিলাগড় এলাকার একটি মেসে থেকে পড়াশুনা করছেন তিনি। গত বছর সিলেট সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন ইমরান। এবার গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হন তিনি। আগামী বছরের শুরুর দিকে গণিত কিংবা পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা শুরু করতে যাচ্ছেন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে ইমরান সবার ছোট। পড়াশুনা শেষ করে তিনি শিক্ষক হতে চান।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে ইমরানের কথা হয় সিলেট এমসি কলেজের পুকুরপাড়ে। সেখানেই বদরুল কুপিয়েছিল নার্গিসকে। নার্গিস সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলেই ভারী হয়ে ওঠে ইমরানের কণ্ঠ। নার্গিসকে বাঁচানোর দিনের কথা মনে করে ইমরান বলেন, ‘এমসি কলেজে কত মানুষের সামনে চাপাতি দিয়ে বদরুল একা আপুকে কোপালো, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসলো না। কয়েকজন এগিয়ে আসলে আপুকে আজ হাসপাতালে থাকতে হতো না।‘
ইমরান বলেন, ‘প্রতিদিনের মতো ঘটনার দিন (৩ অক্টোবর) দুপুর থেকেই এমসি কলেজে একা একা ঘুরছিলাম। কখনও পুকুর পাড়ে, কখনও শহীদ মিনারে। পরীক্ষা শেষ করে বিকালে যখন হল থেকে পরীক্ষার্থীরা বের হচ্ছিল, তখন আমি অবস্থান করছিলাম ক্যাম্পাসের ভেতরে রসায়ন বিভাগের সামনে। হঠাৎ করে চিৎকার শুনি, সঙ্গে মানুষের দৌড়।’
তিনি বলেন, ‘একটু এগিয়ে দেখি চাপাতির রক্ত মুছতে মুছতে ক্যান্টিনের সামনে দিয়ে একটি লোক (বদরুল) তাড়াহুড়া করে যাচ্ছে। পুকুর পাড়ে গিয়ে দেখতে পাই নার্গিস আপুর নিথর দেহ মাটিতে পড়ে আছে। সাহস করে নিজেই একা কাঁধে করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। কাঁধে তুলে নিতে গেলে পুরো শরীর রক্তে ভেসে যায়। এরপর চিৎকার শুরু করি। চিৎকার শুনে এমসি কলেজের শিক্ষার্থী আলামিন ও মাহফুজ ভাই নামের আরও দুইজন ছুটে আসলে সিএনজি অটোরিকশা করে নার্গিস আপুকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।‘ নার্গিসের শরীর থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে ইমরানই প্রথমে তাকে ‘এ’ পজিটিভ গ্রুপের এক ব্যাগ রক্ত দেন।
হাসপাতালে চিকিৎসা করে নার্গিস নতুন জীবন ফিরে পাওয়ায় ইমরান আনন্দিত। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে নেওয়ার সময় আমি ভেবেছিলাম তাকে আর বাঁচানো সম্ভব নয়। সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে যাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম হাসপাতালে নিয়ে গেলেও মনে হয় তাকে আর বাঁচানো যাবে না। তারপরও ভাবলাম, চেষ্টা করেই দেখি। আমি চাই নার্গিস আপু দ্রুত সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসুক। আবারও যেন শুরু হয় আপুর কলেজে আসা-যাওয়া।’
উল্লেখ্য, গত ৩ অক্টোবর সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী খাদিজা আক্তার নার্গিস পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে। পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফেরার সময় এমসি কলেজের পুকুরপাড়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী বদরুল আলমের চাপাতির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন নার্গিস। ওই সময় রক্তাক্ত নার্গিসের সাহায্যে এগিয়ে আসেন ইমরান কবীর। প্রথমে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে সেখান থেকে সেদিন রাতেই নার্গিসকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। স্কয়ার হাসপাতালে ৫৫ দিন চিকিৎসা শেষে ফিজিওথেরাপির জন্য তাকে সাভারের সিআরপিতে (পক্ষাঘাত পুনর্বাসন কেন্দ্র) পাঠানো হয়। -বাংলা ট্রিবিউন।
১৮ ডিসেম্বর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম