ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে : হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী স্পিকার। আবদুস সামাদ আজাদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা। তিন জাঁদরেল নেতার দাপটে কাঁপতো সিলেটের রাজনীতি। তাদের অনুসারীরাও স্থানীয় রাজনীতিতে ছিলেন জৌলসপূর্ণ নেতা। ওই সময় গ্রুপিং-কোন্দলে জর্জরিত ছিল আওয়ামী লীগ।
কিন্তু তিন বর্ষীয়ান নেতার বলয়ে নেতার অভাব ছিল না। যারা ওই সময় বিভিন্ন গ্রুপের হয়ে স্থানীয়ভাবে প্রতিনিধিত্ব করেছেন তারাই এখন সিলেট আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা। নেতৃত্ব দিচ্ছেন কেন্দ্রেও। তবে সেই স্বর্ণযুগ শেষ। হুমায়ুন রশীদ, সামাদ আজাদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের যৌবনময় আওয়ামী লীগ এখন আর সিলেটে নেই। তিন নেতার বিদায়ে রাজনীতির বর্ণিলতাও কমে এসেছে। স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর আব্দুস সামাদ আজাদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের রাজনীতি যেন সিলেটে খেই হারিয়ে ফেলেছিল।
এ দু’জনের কোন্দলপূর্ণ রাজনীতি শেষ পর্যন্ত সুনামগঞ্জের রাজনীতিকে চাঙ্গা করে রেখেছিল। কিন্তু আব্দুস সামাদ আজাদের মৃত্যুর পর নিশ্চুপ পড়ে ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ‘দাদা’ বলে পরিচিত বর্ষীয়ান নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বলা হচ্ছে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সিলেটে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সর্বশেষ নক্ষত্রের অবসান হয়ে গেছে। এই রাজনীতি নিকট অতীতে কী সিলেট আওয়ামী লীগ পাবে- এই প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে গোটা বিভাগের সর্বত্রই।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ঘরানা থেকে সিলেট আওয়ামী লীগ অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়েছে। কেউ বাকি রইলেন না। যারা কাঁপিয়েছেন সিলেট, মাতিয়েছেন সিলেটের মানুষকে। তারাই এখন অতীত হয়ে গেলেন। ৫ই ফেব্রুয়ারি চলে গেলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সোমবার সন্ধ্যার আগে আগেই তাকে নিজ বাড়ি দিরাইয়ের আনোয়ারপুরে চিরবিদায় জানানো হলো। তার বিদায়ে উপস্থিত ছিলেন সিলেট বিভাগের আওয়ামী লীগের সব সারির নেতারা।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত সিলেটবাসী হারিয়েছেন ১১ জন জাতীয় নেতাকে। যারা সিলেটের উন্নয়ন অগ্রগতিকে টেনে নিয়েছেন অনেক দূর। তাদের হাত ধরেই স্বাধীনতা-উত্তর সিলেট পেয়েছে পূর্ণতা। এ অঞ্চলের মানুষের ছায়াসঙ্গী হয়ে কাজ করেছেন অবিরাম। জীবন উৎসর্গ করেছেন সিলেটের জন্যই। এই নেতাদের কোনো দিনই ভুলবে না সিলেটের কোটি জনতা। দক্ষিণ এশিয়ার জাঁদরেল কূটনীতিক, পররাষ্ট্র সচিব, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্পিকার মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, সাবেক এসকাপের পররাষ্ট্র সচিব, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া, জাঁদরেল কূটনীতিক, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাবেক উপদেষ্টা মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজী, সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলী, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল এমএজি ওসমানী, বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এম সাইফুর রহমান, সিলেট জেলা বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা ও কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক এমপি খন্দকার আব্দুল মালেক, উপমহাদেশের প্রখ্যাত বাম রাজনীতিবিদ কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক এমপি ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বরুণ রায়, ন্যাপ-এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি সিলেট গান্ধী পীর হবিবুর রহমান সবাই ছিলেন সিলেটের অভিভাবক।
সর্বশেষ রোববার সবাইকে কাঁদিয়ে পরপারে পাড়ি জমালেন এই নেতা। স্পিকার হুমায়ুন রশীদের বাড়ি সিলেটে। প্রখ্যাত রশীদ ফ্যামেলির সন্তান তিনি। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি স্বীকৃতি আদায়ের জন্য তিনি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা করেন। এর আগে তিনি রোম, বাগদাদ, প্যারিস, লিসবন ও জাকার্তায় কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৪১তম অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালে তিনি পর পর জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পুনরায় তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন।
১৯৯৬ সালের ১৪ই জুলাই তিনি সর্বসম্মতিক্রমে জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ১০ই জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আব্দুস সামাদ আজাদ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ৫ম সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা। শুধু বাংলাদেশেই নয় দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে তার অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি ২০০৫ সালে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে কিবরিয়া ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। শাহ কিবরিয়া ২৭শে জানুয়ারি ২০০৫ সালে নিজ নির্বাচনী এলাকা সিলেটের হবিগঞ্জের বৈদ্যেরবাজারে গ্রেনেড হামলায় মর্মান্তিকভাবে নিহত হন।
আওয়ামী লীগ উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য দেওয়ান ফরিদ গাজী ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সিলেট সদর আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গনের ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা ও প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৭ই ডিসেম্বর সিলেট ডেপুটি কমিশনারের কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলনও হয় তারই হাতে। দেওয়ান ফরিদ গাজী ২০১০ সালের ১৯শে নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম সাইফুর রহমান ছিলেন সিলেট উন্নয়নের আরেক রূপকার। তিনি ছিলেন দেশের একমাত্র ও প্রথম অর্থমন্ত্রী যিনি ১২ বার সংসদে বেশ সফলতার সঙ্গে বাজেট পেশ করেছেন। নিজ জন্মস্থান মৌলভীবাজারসহ পুরো সিলেট বিভাগেই রয়েছে তার চোখ ধাঁধানো উন্নয়নের ছোঁয়া। তিনি ২০০৯ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের খড়িয়ালা নামক স্থানে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। তার মৃত্যুর পর সিলেট বিএনপির অভিভাবকশূন্যতা এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি।
প্রয়াত সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলী। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি বিএনপি নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে আবার বিজয়ী হওয়ার পর তাকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান অবিস্মরণীয়। ২০১৫ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালে তিনি মারা যান।
১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার, তখন সিলেটের কৃতীসন্তান এমএজি ওসমানীকে করা হয় মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার্থে লন্ডন থাকাকালীন ১৯৮৪ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি ইন্তেকাল করেন এই মহাবীর।
আর কমরেড বরুণ রায় উপমহাদেশের প্রখ্যাত বাম রাজনীতির পুরোধা। ১৯৮৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে ৮ দল কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে সুনামগঞ্জ-১ নির্বাচনী এলাকা (জামালগঞ্জ, ধরমপাশা, তাহিরপুর) থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের বজ্রকণ্ঠের কারণেই। তিনি জীবনের বেশির ভাগ সময়ই ছিলেন জেলে। ২০০৯ সালের ৮ই ডিসেম্বর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। বরুণ রায়ের রাজনীতির ছাপ ছিল ভাটিবাংলার সিংহপুরুষ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের উপর।
দেশের প্রথম সংবিধান প্রণেতা কমিটির অন্যতম সদস্য সুরঞ্জিতের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় বামপন্থি রাজনীতির মধ্য দিয়ে। স্বাধীন দেশের প্রথম সংসদসহ তিনি সাত বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর রেলমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন সুরঞ্জিত। গত রোববার মৃত্যুবরণ করেন সুরঞ্জিত। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্যের দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
তাছাড়াও দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন সিলেট গান্ধীখ্যাত ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি পীর হবিবুর রহমান ও বিএনপি’র সাবেক এমপি খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। তারাও এক সময় সিলেটের রাজনীতি ও উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রেখে গেছেন। এমজমিন
০৮ ফেব্রুয়ারি,২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসবি